Wednesday, 31 May 2017

জামাইষষ্ঠী

সারা পৃথিবী জুড়েই এক একটা দিনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য নামকরণ করা হয় — আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস, ভাষাদিবস, কৃষাণ দিবস, মাতৃত্ব দিবস, শিশু দিবস ইত্যাদি | পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজ বিজ্ঞানীরা বা রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এতকাল পরে যেটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা আমাদের দেশের মুনি-ঋষিগণ বা সমাজের বিধানদাতারা ভেবেছেন অনেক আগেই | আর তারই ফলস্বরূপ রক্তের বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন বা সামাজিক বন্ধনকে অটুট রাখতে বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও জোরালো করতে তাঁরা সমাজে চালু করেছেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, রাখীবন্ধন ইত্যাদি | আর এতেই সম্ভবত সর্বশেষ সংযোজন জামাইষষ্ঠী |


আমাদের দেশে সেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই বহুদেবত্ববাদের পূজারি হিন্দু মুনিঋষিগণ বিভিন্ন দেবদেবীর পাশাপাশি কিছু উপদেবতারও পুজো করতেন | ‘ষষ্ঠী’ বা ‘মা ষষ্ঠী’ সেইরকমই এক উপদেবতা | সম্ভবত শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার অত্যধিক বেশি হওয়ায় শিশুর জন্ম ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং প্রসূতির জীবনরক্ষার ভার ন্যস্ত করা হয় এই মা ষষ্ঠীর কাছে | তাই সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়েরা ষষ্ঠীর পুজো করে থাকেন | এখন প্রশ্ন উঠতে পারে — মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই-এর সম্পর্ক কী?
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না | এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল — সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য | সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে | যেখানে মেয়ে জামাইকে নেমন্তন্ন করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে | বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে — কন্যার পিতামাতা অথবা যে ব্যক্তি কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি এক বৎসর কন্যার বাড়ি যাবেন না বা গেলেও কন্যার বাড়ির অন্নগ্রহণ করবেন না | যদিও আধুনিক শহুরে জীবনে এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না | সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে জামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেইসঙ্গে কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণ হল জামাই ষষ্ঠী।
 জামাইকে কেন্দ্র করে ষষ্ঠী উৎসব পালন করা হয় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে | কন্যার বিবাহের মাধ্যমে একটি পরিবারের সঙ্গে আর একটি পরিবারের যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সেই সম্পর্ককে সুদৃঢ় করাই এই জামাই ষষ্ঠীর উদ্দেশ্য | তাই এদিন মেয়ে-জামাইকে যেমন নেমন্তন্ন করা হয় তেমনি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও ডাকা হয় | সকলে অন্তরঙ্গভাবে মিলেমিশে মহা সমারোহে এই ধর্মীয় তথা সামাজিক উৎসব পালন করে |
 জামাই ষষ্ঠী মানেই বাঙালিদের কাছে কার্যত উৎসব। বহু জামাই আছেন এমন দিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে মিষ্টির ঝোলা ও বিশাল মাছ হাতে শ্বশুরবাড়িতে হাজির হতে পছন্দ করেন। কিন্তু, জামাই হল গিয়ে মেয়ের বর। মেয়েকে ছেড়ে জামাই আদরের এত ঘটা কেন? সেটা কখনও কেউ কি ভেবেছেন?

কথাতেই আছে ‘যম-জামাই-ভাগনা- কেউ নয় আপনা। বাঙালি সমাজে এটাই প্রচলিত প্রবাদ।
কিন্তু, নতুন পাখার উপর আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মনঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল ‘জামাই ষষ্ঠী!-র দিনে যে ব্রত রক্ষায় ব্রতী হন তার সারমর্মটা কী?
এখানেই শেষ নয়, ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পুজোর উপকরণ সাজাতে হয়। করমচা-সহ পাঁচ থেকে সাত বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার উপর সাজিয়ে রাখতে হয় শাশুড়িকে।
যে জামাই কখনও আপন হয় না বলে প্রবাদ, তাহলে তার জন্য এত ঘটার আয়োজন আর আদিখ্যেতার বহর! পুজোর শেষে জামাইকে পাখা হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া! এমনকী, মা ষষ্ঠীর আশির্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া! এ সবই বা কেন?
আছে সবকিছুরই পিছনে গভীর স্বার্থ। আর এই স্বার্থটা হল জামাইকে তোষামেদ। কারণ, এতে মেয়ে ভাল থাকবে। যম মানুষের মৃত্যু দূত। ভাগনা অন্যের বাড়ির ছেলে। কিন্তু, জামাই অন্যের বাড়ি হলেও মেয়ের সম সঙ্গে সাংসরিক বন্ধনে থাকায় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ। তাই যম, ভাগনা ছেড়ে জামাইকে আপ্যায়ণের মানে মেয়েকে ভাল রাখা। তাই হাজারো লোকাচার। হাজারো বিধি পালনের হিড়িক।
জামাই-এর মঙ্গলার্থে ধান-এর ব্যবহার। কারণ, ধান সমৃদ্ধির ও বহু সন্তানের প্রতীক। দুর্বা ব্যবহৃত হয় চুর সবুজ ও চির সতেজের প্রতীক হিসাবে। এর মানে জামাই-এর দীর্ঘায়ু কামনা। এখানেই শেষ নয় জামাই-কে আশীর্বাদ করে ষাট-ষাট বলাটাও শাশুড়িদের নিয়মের মধ্যে পড়ে। মনে রাখবেন এর সমস্তটাই হচ্ছে শুধু জামাই-এর জন্য। আসলে মেয়ের জন্য মঙ্গলচিন্তা এবং তাঁর সংসার অঁটুট রাখার প্রার্থনাতেই এত আয়োজন হয়।

ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা | তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম | কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল | ছোট বউ ছিল খুব লোভী | বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে |’ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন | তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল | মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন | ফলে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন | এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন | ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় | অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে |
যাই হোক, ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যায় ও একাকী কাঁদতে থাকে | শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান | সে তার দুঃখের কথা বলে | তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় | ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন | এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে | তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় | এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে | এটাই জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতকথার মূল গল্প |
এদিকে যে সময় জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে, প্রকৃতিতে আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি নানা ফলের সমারোহ | তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীর পূজা করেন | তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে বসিয়ে প্রথমে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন ও দীর্ঘজীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক তেল-হলুদে চোবানো সুতো হাতের কবজিতে বেঁধে দেন | এরপর আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন | আর সামনে বিবিধ মিষ্টান্নসহ নানা ফল খেতে দেন | অবশ্য জামাই বাবাজীও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় যেমন দই-মিষ্টি আনতে ভোলে না তেমনি আশীর্বাদের পর প্রণামী হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্রাদি দিয়ে থাকে | এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য — শুধুই জামাই নয়, মেয়েও কিন্তু বস্ত্রাদি উপহার হিসাবে পেয়ে থাকে |

সমারোহের ব্যাপার বোঝা যায় দুপুরের আহারে | তখন গরমভাতে ঘি থেকে শুরু করে শেষে পানমশলা | মাছ, বাঙালির প্রিয় এবং মাঙ্গলিক বলে — ইলিশমাছের পাতুরি, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, দই-রুই, ভেটকি মাছের ফ্রাই ইত্যাদি মাছেরই অনেক রকম পদ এবং মাংস (জামাই রাত্রে থাকলে সাধারণত
রাত্রে হয়), চাটনি, দই, মিষ্টি ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জন ভাতের (বাসমতী বা গোবিন্দভোগ চালের) থালার চারপাশে সাজিয়ে দেওয়া হয় |
আগেকার দিনে শাশুড়িরা সাধারণত জামাইকে খেতে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতেন | এখন ইলেকট্রিক ফ্যান আর এসি-র দৌলতে তার আর প্রয়োজন হয় না | বছরের পর বছর এইভাবে চলতে থাকায় ভগ্নীপতিরা কখন যে শ্যালকদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে তা বোঝা যায় না | পরবর্তীকালে অনেক সময় দেখা গেছে এই ভগ্নীপতিরাই ছোট ছোট শ্যালকদের মনের অগোচরে অভিভাবকের স্থান দখল করেছেন | তবে দুঃখের বিষয় আজ আর সেদিন নেই | শ্বশুর-শাশুড়ি যতদিন আছেন বা সংসারে তাঁদের কর্তৃত্ব আছে ততদিনই জামাইদের আদর-আপ্যায়ন থাকে | পরবর্তী কালে সম্পত্তি আইনে, বাবার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর ভাই এবং বিবাহিত বোন সমান অংশীদার হওয়ায় রক্তের সম্পর্কও ব্যবসায়িক সম্পর্কে পরিণত হচ্ছে | বেশিরভাগ সংসারেই ভগ্নীপতিকে সংসারের / পরিবারের একজন না ভেবে পর ভাবা হচ্ছে | এইভাবে সমাজে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কও যেমন হারাচ্ছে, তেমনি হারাচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতি |
তথ্যসুত্র ও ছবি -গুগল সৌজন্যে 

Saturday, 15 April 2017

বাংলা শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ


বাংলা শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত।এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন বাংলা শুভ নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতেহত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।
  বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে।কিন্তু এপার বাংলায় যেদিন চৈত্র সঙ্ক্রান্তি,সেদিন কেন পয়লা বৈশাখের উদযাপন ওপার বাংলায় ! ঢাকা চারুকলা অ্যাকাডেমির সদস্য মোল্লা সাগর বললেন ,"দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশের এরশাদ সরকার ।আটের দশকে ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে একটি স্ট্যান্ডার্ড ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয় ।তারপর থেকেই ওপার বাংলার সঙ্গে আমাদের ক্যালেন্ডার এক দিন এগিয়ে।" (তথ্যসুত্র -এই সময় ,১৫ এপ্রিল,২০১৭)  বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
 কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে   যাক।’...।।    
                                                                    বাংলা মায়ের হৃদয়ের দুটি অলিন্দ , পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা ,ধর্মের রীতিটুকু বাদ দিলে সব ধর্মের বাঙ্গালীর আচার অনুষ্ঠান এক ই হওয়া  বাঞ্ছনীয় । ১ লা বৈশাখ একান্তই বাংলার এবং বাঙ্গালীর নিজের অনুষ্ঠান ।গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিদায় করে আরবিও সংস্কৃতি আনার যে চেষ্টা চলছে তারই ফলশ্রুতি দুই বাংলায় দুই দিন নববর্ষ । নিজেদের ঐতিহ্য কে বিসর্জন দিয়ে অন্য ভাষার সংস্কৃতি কে বরন করা খুব বেশী গৌরবের বলে আমার মনে হয় না ।দুই বাংলার নববর্ষের তারিখ টা এক হলে অন্তত মনে হবে ,উৎসবটা আমাদের উৎসব ,বাংলার উৎসব , বাঙ্গালির উৎসব ।
ক্যালেন্ডারের কোনও ধর্ম হয়না , অন্তত এক দিনের জন্য হলেও আসুন , আমরা হিন্দু নই,মুসলিম নই , বৌদ্ধ নই, খ্রিস্টান নই , বাঙালি হই ।
বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু  হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে  রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়। বাংলাদেশে বসবাসকারী আমার ভাই বোন ও বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি ,সরকারি এই ক্যালেন্ডার আদতে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনে কোনও প্রভাব ফেলেনি । সাগর বাবুর কথায়, 'হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ বাংলা পঞ্জিকা মেনেই চলেন। তাঁদের পূজাপার্বণ, চাষ বাসের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় বাংলা তিথি পঞ্জিকা মেনেই ।' সাংবাদিক মিলন দত্তের মতে 'এখনও পঞ্জিকা মেনে বাংলাদেশের মানুষ ১ লা বৈশাখে চাষের লাঙল কাস্তে ধুয়ে মুছে রাখেন ।তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এখনও এই ক্যালেন্ডার স্থান পায়নি।'( তথ্যসুত্র-এই সময় ,১৫ এপ্রিল,২০১৭)
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত। ওপারের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার এপার বাংলায়। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় ১ লা বৈশাখ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যাদবপুর থেকে ঢাকুরিয়া পর্যন্ত এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ১৯৮৯। একদিকে সেনা শাসন। অন্যদিকে বন্যা। প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদন এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাংলাদেশ। জন অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় একাধিক মানুষের। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। স্থির হয় পয়লা বৈশাখ পথে নামবেন ছাত্রছাত্রীরা। সেটাই শুরু। এরপর থেকে ফি বছর পয়লা বৈশাখ মঙ্গলশোভাযাত্রা হয়ে আসছে ঢাকার রাজপথে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন অসংখ্য মানুষ। মঙ্গল শোভাযাত্রাও হেরিটেজ স্বীকৃতি পায় ইউনেস্কোর।এবার এপার বাংলায় ১লা বৈশাখ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। কলকাতার রাজপথে হাঁটবেন দুই বাংলার সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ। গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলশোভাযাত্রা শেষ হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। শোভাযাত্রা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজির হয়েছেন অসংখ্য শিল্পী। তাঁদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে শোভাযাত্রায়। রাস্তা জুড়ে আঁকবেন শিল্পীরা। চলবে গান, নাটক ও কবিতা। ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। অপেক্ষা পয়লা বৈশাখের সকালের।( তথ্যসুত্র-২৪ ঘণ্টা ,৯ এপ্রিল ২০১৭)
ছবি- ২৪ ঘণ্টা
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ । ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে।  শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।  
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া বাংলা,এই সময়,২৪ ঘণ্টা