Wednesday, 31 May 2017

জামাইষষ্ঠী

সারা পৃথিবী জুড়েই এক একটা দিনকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার জন্য নামকরণ করা হয় — আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস, ভাষাদিবস, কৃষাণ দিবস, মাতৃত্ব দিবস, শিশু দিবস ইত্যাদি | পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সমাজ বিজ্ঞানীরা বা রাজনৈতিক নেতৃবর্গ এতকাল পরে যেটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন তা আমাদের দেশের মুনি-ঋষিগণ বা সমাজের বিধানদাতারা ভেবেছেন অনেক আগেই | আর তারই ফলস্বরূপ রক্তের বন্ধন, আত্মীয়তার বন্ধন বা সামাজিক বন্ধনকে অটুট রাখতে বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরও জোরালো করতে তাঁরা সমাজে চালু করেছেন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, রাখীবন্ধন ইত্যাদি | আর এতেই সম্ভবত সর্বশেষ সংযোজন জামাইষষ্ঠী |


আমাদের দেশে সেই অতি প্রাচীনকাল থেকেই বহুদেবত্ববাদের পূজারি হিন্দু মুনিঋষিগণ বিভিন্ন দেবদেবীর পাশাপাশি কিছু উপদেবতারও পুজো করতেন | ‘ষষ্ঠী’ বা ‘মা ষষ্ঠী’ সেইরকমই এক উপদেবতা | সম্ভবত শিশুমৃত্যু ও প্রসূতি মৃত্যুর হার অত্যধিক বেশি হওয়ায় শিশুর জন্ম ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং প্রসূতির জীবনরক্ষার ভার ন্যস্ত করা হয় এই মা ষষ্ঠীর কাছে | তাই সন্তানের মঙ্গল কামনায় মায়েরা ষষ্ঠীর পুজো করে থাকেন | এখন প্রশ্ন উঠতে পারে — মা ষষ্ঠীর সঙ্গে জামাই-এর সম্পর্ক কী?
ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একসময় সংস্কার ছিল কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা বা মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না | এই ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল — সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য | সেক্ষেত্রে বিবাহিত কন্যার মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতা জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লা ষষ্ঠীকে বেছে নিলেন জামাই ষষ্ঠী হিসাবে | যেখানে মেয়ে জামাইকে নেমন্তন্ন করে সমাদর করা হবে ও কন্যার মুখ দর্শন করা যাবে আর সেইসঙ্গে মা ষষ্ঠীর পুজো করে তাঁকে খুশি করা যাতে কন্যা শীঘ্র পুত্রমুখ দর্শন করতে পারে | বর্তমানে অবশ্য এই সংস্কার পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে — কন্যার পিতামাতা অথবা যে ব্যক্তি কন্যা সম্প্রদান করবেন তিনি এক বৎসর কন্যার বাড়ি যাবেন না বা গেলেও কন্যার বাড়ির অন্নগ্রহণ করবেন না | যদিও আধুনিক শহুরে জীবনে এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না | সংস্কার যাই হোক না কেন, মেয়ে জামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেইসঙ্গে কন্যা যাতে সন্তানবতী হয় সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণ হল জামাই ষষ্ঠী।
 জামাইকে কেন্দ্র করে ষষ্ঠী উৎসব পালন করা হয় প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে | কন্যার বিবাহের মাধ্যমে একটি পরিবারের সঙ্গে আর একটি পরিবারের যে সম্পর্ক স্থাপন করা হয় সেই সম্পর্ককে সুদৃঢ় করাই এই জামাই ষষ্ঠীর উদ্দেশ্য | তাই এদিন মেয়ে-জামাইকে যেমন নেমন্তন্ন করা হয় তেমনি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদেরও ডাকা হয় | সকলে অন্তরঙ্গভাবে মিলেমিশে মহা সমারোহে এই ধর্মীয় তথা সামাজিক উৎসব পালন করে |
 জামাই ষষ্ঠী মানেই বাঙালিদের কাছে কার্যত উৎসব। বহু জামাই আছেন এমন দিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে হাতে মিষ্টির ঝোলা ও বিশাল মাছ হাতে শ্বশুরবাড়িতে হাজির হতে পছন্দ করেন। কিন্তু, জামাই হল গিয়ে মেয়ের বর। মেয়েকে ছেড়ে জামাই আদরের এত ঘটা কেন? সেটা কখনও কেউ কি ভেবেছেন?

কথাতেই আছে ‘যম-জামাই-ভাগনা- কেউ নয় আপনা। বাঙালি সমাজে এটাই প্রচলিত প্রবাদ।
কিন্তু, নতুন পাখার উপর আমের পল্লব এবং আম ও তৎসহযোগে পাঁচ ধরনের ফল সাজিয়ে জামাই-এর মনঙ্গল কামনায় শাশুড়ির দল ‘জামাই ষষ্ঠী!-র দিনে যে ব্রত রক্ষায় ব্রতী হন তার সারমর্মটা কী?
এখানেই শেষ নয়, ১০৮টি দুর্বাবাঁধা আঁটি দিয়ে পুজোর উপকরণ সাজাতে হয়। করমচা-সহ পাঁচ থেকে সাত বা নয় রকমের ফল কেটে কাঁঠাল পাতার উপর সাজিয়ে রাখতে হয় শাশুড়িকে।
যে জামাই কখনও আপন হয় না বলে প্রবাদ, তাহলে তার জন্য এত ঘটার আয়োজন আর আদিখ্যেতার বহর! পুজোর শেষে জামাইকে পাখা হাওয়া আর শান্তি জলের ছিটা দেওয়া! এমনকী, মা ষষ্ঠীর আশির্বাদ বলে জামাইয়ের হাতে হলুদ মাখানো সুতো পরিয়ে দেওয়া! এ সবই বা কেন?
আছে সবকিছুরই পিছনে গভীর স্বার্থ। আর এই স্বার্থটা হল জামাইকে তোষামেদ। কারণ, এতে মেয়ে ভাল থাকবে। যম মানুষের মৃত্যু দূত। ভাগনা অন্যের বাড়ির ছেলে। কিন্তু, জামাই অন্যের বাড়ি হলেও মেয়ের সম সঙ্গে সাংসরিক বন্ধনে থাকায় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কে আবদ্ধ। তাই যম, ভাগনা ছেড়ে জামাইকে আপ্যায়ণের মানে মেয়েকে ভাল রাখা। তাই হাজারো লোকাচার। হাজারো বিধি পালনের হিড়িক।
জামাই-এর মঙ্গলার্থে ধান-এর ব্যবহার। কারণ, ধান সমৃদ্ধির ও বহু সন্তানের প্রতীক। দুর্বা ব্যবহৃত হয় চুর সবুজ ও চির সতেজের প্রতীক হিসাবে। এর মানে জামাই-এর দীর্ঘায়ু কামনা। এখানেই শেষ নয় জামাই-কে আশীর্বাদ করে ষাট-ষাট বলাটাও শাশুড়িদের নিয়মের মধ্যে পড়ে। মনে রাখবেন এর সমস্তটাই হচ্ছে শুধু জামাই-এর জন্য। আসলে মেয়ের জন্য মঙ্গলচিন্তা এবং তাঁর সংসার অঁটুট রাখার প্রার্থনাতেই এত আয়োজন হয়।

ষষ্ঠী-পালন সাধারণত করে থাকেন মেয়েরা | তাঁদের কাছে এর তাৎপর্য অন্যরকম | কথিত আছে — এক পরিবারে দুটি বউ ছিল | ছোট বউ ছিল খুব লোভী | বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব কালো বেড়ালে খেয়ে নিয়েছে |’ বেড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন | তাই বেড়াল, মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল | মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন | ফলে ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন | এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন | ফলে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষণা’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় | অথচ বড় বউ পুত্রকন্যাদের নিয়ে সুখে ঘর করতে থাকে |
যাই হোক, ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যায় ও একাকী কাঁদতে থাকে | শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান | সে তার দুঃখের কথা বলে | তখন মা ষষ্ঠী তার পূর্বের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায় | ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন | এরপর বলেন — ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পুজো করলে সাতপুত্র ও এক কন্যার জীবন ফিরে পাবে | তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পুজো করে ও ক্রমে ক্রমে তার পুত্র কন্যাদের ফিরে পায় | এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠী পুজোর মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে | এটাই জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্যষষ্ঠী ব্রতকথার মূল গল্প |
এদিকে যে সময় জামাই ষষ্ঠী পালন করা হয় অর্থাৎ জৈষ্ঠ্য মাসে, প্রকৃতিতে আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি নানা ফলের সমারোহ | তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীর পূজা করেন | তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে বসিয়ে প্রথমে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন ও দীর্ঘজীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক তেল-হলুদে চোবানো সুতো হাতের কবজিতে বেঁধে দেন | এরপর আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন | আর সামনে বিবিধ মিষ্টান্নসহ নানা ফল খেতে দেন | অবশ্য জামাই বাবাজীও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় যেমন দই-মিষ্টি আনতে ভোলে না তেমনি আশীর্বাদের পর প্রণামী হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্রাদি দিয়ে থাকে | এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য — শুধুই জামাই নয়, মেয়েও কিন্তু বস্ত্রাদি উপহার হিসাবে পেয়ে থাকে |

সমারোহের ব্যাপার বোঝা যায় দুপুরের আহারে | তখন গরমভাতে ঘি থেকে শুরু করে শেষে পানমশলা | মাছ, বাঙালির প্রিয় এবং মাঙ্গলিক বলে — ইলিশমাছের পাতুরি, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, দই-রুই, ভেটকি মাছের ফ্রাই ইত্যাদি মাছেরই অনেক রকম পদ এবং মাংস (জামাই রাত্রে থাকলে সাধারণত
রাত্রে হয়), চাটনি, দই, মিষ্টি ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জন ভাতের (বাসমতী বা গোবিন্দভোগ চালের) থালার চারপাশে সাজিয়ে দেওয়া হয় |
আগেকার দিনে শাশুড়িরা সাধারণত জামাইকে খেতে দিয়ে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতেন | এখন ইলেকট্রিক ফ্যান আর এসি-র দৌলতে তার আর প্রয়োজন হয় না | বছরের পর বছর এইভাবে চলতে থাকায় ভগ্নীপতিরা কখন যে শ্যালকদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে তা বোঝা যায় না | পরবর্তীকালে অনেক সময় দেখা গেছে এই ভগ্নীপতিরাই ছোট ছোট শ্যালকদের মনের অগোচরে অভিভাবকের স্থান দখল করেছেন | তবে দুঃখের বিষয় আজ আর সেদিন নেই | শ্বশুর-শাশুড়ি যতদিন আছেন বা সংসারে তাঁদের কর্তৃত্ব আছে ততদিনই জামাইদের আদর-আপ্যায়ন থাকে | পরবর্তী কালে সম্পত্তি আইনে, বাবার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির উপর ভাই এবং বিবাহিত বোন সমান অংশীদার হওয়ায় রক্তের সম্পর্কও ব্যবসায়িক সম্পর্কে পরিণত হচ্ছে | বেশিরভাগ সংসারেই ভগ্নীপতিকে সংসারের / পরিবারের একজন না ভেবে পর ভাবা হচ্ছে | এইভাবে সমাজে ভাইবোনের মধুর সম্পর্কও যেমন হারাচ্ছে, তেমনি হারাচ্ছে বাঙালির সংস্কৃতি |
তথ্যসুত্র ও ছবি -গুগল সৌজন্যে 

Saturday, 15 April 2017

বাংলা শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ


বাংলা শুভ নববর্ষ পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে শুভ নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়।
হিন্দু সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারটি মাস অনেক আগে থেকেই পালিত হত। এই সৌর পঞ্জিকার শুরু হত গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় হতে। হিন্দু সৌর বছরের প্রথম দিন আসাম, বঙ্গ, কেরল, মনিপুর, নেপাল, উড়িষ্যা, পাঞ্জাব, তামিল নাড়ু এবং ত্রিপুরার সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অনেক আগে থেকেই পালিত হত।এখন যেমন নববর্ষ নতুন বছরের সূচনার নিমিত্তে পালিত একটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে, এক সময় এমনটি ছিল না। তখন বাংলা শুভ নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ আর্তব উৎসব তথা ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে পালিত হত। তখন এর মূল তাৎপর্য ছিল কৃষিকাজ। প্রাযুক্তিক প্রয়োগের যুগ শুরু না হওয়ায় কৃষকদের ঋতুর উপরই নির্ভর করতে হত।

ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সাথে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করতেহত। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।

আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপন শুরু হয়। তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সকল খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হত। এর পর দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করতেন। এ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হত। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয় যার রুপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে। তখনকার সময় এই দিনের প্রধান ঘটনা ছিল একটি হালখাতা তৈরি করা। হালখাতা বলতে একটি নতুন হিসাব বই বোঝানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে হালখাতা হল বাংলা সনের প্রথম দিনে দোকানপাঠের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা, সকল স্থানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে নতুন হিসাব বই খোলা হয়। হালখাতার দিনে দোকনদাররা তাদের ক্রেতাদের মিষ্টান্ন আপ্যায়ন করে থাকে। এই প্রথাটি এখনও অনেকাংশে প্রচলিত আছে, বিশেষত স্বর্ণের দোকানে।

আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি।
  বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে।কিন্তু এপার বাংলায় যেদিন চৈত্র সঙ্ক্রান্তি,সেদিন কেন পয়লা বৈশাখের উদযাপন ওপার বাংলায় ! ঢাকা চারুকলা অ্যাকাডেমির সদস্য মোল্লা সাগর বললেন ,"দুই বাংলার সাংস্কৃতিক বিভাজন ঘটাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বাংলাদেশের এরশাদ সরকার ।আটের দশকে ঢাকা বাংলা অ্যাকাডেমির উদ্যোগে একটি স্ট্যান্ডার্ড ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয় ।তারপর থেকেই ওপার বাংলার সঙ্গে আমাদের ক্যালেন্ডার এক দিন এগিয়ে।" (তথ্যসুত্র -এই সময় ,১৫ এপ্রিল,২০১৭)  বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এদিন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
 কবি অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল/আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে/ভাগ হয়নিকো নজরুল/এই ভুলটুকু বেঁচে থাক/বাঙালি বলতে একজন আছে/দুর্গতি তাঁর ঘুচে   যাক।’...।।    
                                                                    বাংলা মায়ের হৃদয়ের দুটি অলিন্দ , পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা ,ধর্মের রীতিটুকু বাদ দিলে সব ধর্মের বাঙ্গালীর আচার অনুষ্ঠান এক ই হওয়া  বাঞ্ছনীয় । ১ লা বৈশাখ একান্তই বাংলার এবং বাঙ্গালীর নিজের অনুষ্ঠান ।গত দুই দশক ধরে বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতিকে বিদায় করে আরবিও সংস্কৃতি আনার যে চেষ্টা চলছে তারই ফলশ্রুতি দুই বাংলায় দুই দিন নববর্ষ । নিজেদের ঐতিহ্য কে বিসর্জন দিয়ে অন্য ভাষার সংস্কৃতি কে বরন করা খুব বেশী গৌরবের বলে আমার মনে হয় না ।দুই বাংলার নববর্ষের তারিখ টা এক হলে অন্তত মনে হবে ,উৎসবটা আমাদের উৎসব ,বাংলার উৎসব , বাঙ্গালির উৎসব ।
ক্যালেন্ডারের কোনও ধর্ম হয়না , অন্তত এক দিনের জন্য হলেও আসুন , আমরা হিন্দু নই,মুসলিম নই , বৌদ্ধ নই, খ্রিস্টান নই , বাঙালি হই ।
বাংলা দিনপঞ্জীর সঙ্গে হিজরী ও খ্রিস্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো হিজরী সন চাঁদের হিসাবে এবং খ্রিস্টীয় সন ঘড়ির হিসাবে চলে। এ কারণে হিজরী সনে নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যায় নতুন চাঁদের আগমনে। ইংরেজি দিন শুরু  হয় মধ্যরাতে। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু না সূর্যদোয় থেকে থেকে শুরু এটা নিয়ে অনেকের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে, ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যদোয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে  রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু হয়। বাংলাদেশে বসবাসকারী আমার ভাই বোন ও বন্ধুদের সাথে কথা বলে জেনেছি ,সরকারি এই ক্যালেন্ডার আদতে গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনে কোনও প্রভাব ফেলেনি । সাগর বাবুর কথায়, 'হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষ বাংলা পঞ্জিকা মেনেই চলেন। তাঁদের পূজাপার্বণ, চাষ বাসের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় বাংলা তিথি পঞ্জিকা মেনেই ।' সাংবাদিক মিলন দত্তের মতে 'এখনও পঞ্জিকা মেনে বাংলাদেশের মানুষ ১ লা বৈশাখে চাষের লাঙল কাস্তে ধুয়ে মুছে রাখেন ।তাঁদের দৈনন্দিন জীবনে এখনও এই ক্যালেন্ডার স্থান পায়নি।'( তথ্যসুত্র-এই সময় ,১৫ এপ্রিল,২০১৭)
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পয়লা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষারম্ভ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। বিগত বছরের চৈত্র মাসে শহরের অধিকাংশ দোকানে ক্রয়ের উপর দেওয়া হয়ে থাকে বিশেষ ছাড়, যার প্রচলিত কথ্য নাম ‘চৈত্র সেল’। তাই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে এবং এই ছাড়ের সুবিধা গ্রহণ করতে অর্থনৈতিক অবস্থা নির্বিশেষে কলকাতার সমস্ত মানুষ একমাস ধরে নতুন জামাকাপড়, ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। পয়লা বৈশাখের দিন উল্লেখযোগ্য ভিড় চোখে পড়ে কলকাতার বিখ্যাত কালীঘাট মন্দিরে। সেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ভোর থেকে প্রতীক্ষা করে থাকেন দেবীকে পূজা নিবেদন করে হালখাতা আরম্ভ করার জন্য। ব্যবসায়ী ছাড়াও বহু গৃহস্থও পরিবারের মঙ্গল কামনা করে দেবীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে কালীঘাটে গিয়ে থাকেন। এইদিন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোশাক ধুতি-পাঞ্জাবি এবং শাড়ি পরার রেওয়াজ প্রচলিত। ওপারের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবার এপার বাংলায়। এই প্রথম কলকাতার রাস্তায় ১ লা বৈশাখ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। যাদবপুর থেকে ঢাকুরিয়া পর্যন্ত এই শোভাযাত্রায় অংশ নেবেন সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ১৯৮৯। একদিকে সেনা শাসন। অন্যদিকে বন্যা। প্রেসিডেন্ট হুসেন মহম্মদন এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন বাংলাদেশ। জন অভ্যুত্থানে মৃত্যু হয় একাধিক মানুষের। প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা। স্থির হয় পয়লা বৈশাখ পথে নামবেন ছাত্রছাত্রীরা। সেটাই শুরু। এরপর থেকে ফি বছর পয়লা বৈশাখ মঙ্গলশোভাযাত্রা হয়ে আসছে ঢাকার রাজপথে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বয়স নির্বিশেষে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেন অসংখ্য মানুষ। মঙ্গল শোভাযাত্রাও হেরিটেজ স্বীকৃতি পায় ইউনেস্কোর।এবার এপার বাংলায় ১লা বৈশাখ হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। কলকাতার রাজপথে হাঁটবেন দুই বাংলার সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ। গাঙ্গুলিবাগান থেকে শুরু হয়ে মঙ্গলশোভাযাত্রা শেষ হবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে। শোভাযাত্রা উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে হাজির হয়েছেন অসংখ্য শিল্পী। তাঁদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে শোভাযাত্রায়। রাস্তা জুড়ে আঁকবেন শিল্পীরা। চলবে গান, নাটক ও কবিতা। ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। অপেক্ষা পয়লা বৈশাখের সকালের।( তথ্যসুত্র-২৪ ঘণ্টা ,৯ এপ্রিল ২০১৭)
ছবি- ২৪ ঘণ্টা
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহবান। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি বটমূল হলেও প্রকৃত পক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয় সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ । ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে।  শোভাযাত্রার জন্য বানানো নয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সাল থেকে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।

নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ। গ্রামে মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন জামাকাপড় পড়ে এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায়, কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয় বৈশাখী মেলার। মেলাতে থাকে নানা রকম কুঠির শিল্পজাত সামগ্রীর বিপণন, থাকে নানারকম পিঠা পুলির আয়োজন। অনেক স্থানে ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তির। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রাম-এর লালদিঘী ময়দান-এ। এটি জব্বারের বলি খেলা নামে পরিচিত।  
সুত্রঃ উইকিপিডিয়া বাংলা,এই সময়,২৪ ঘণ্টা

Sunday, 6 November 2016

জগদ্ধাত্রী পূজা

সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তবামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্।
চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চ দধতীং দক্ষিণে করে।।
রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্।
নারদাদ্যৈর্মুনিগণৈঃ সেবিতাং ভবসুন্দরীম্।।
ত্রিবলীবলয়োপেতনাভিনালমৃণালিনীম্।
রত্নদ্বীপে মহাদ্বীপে সিংহাসনসমন্বিতে।
প্রফুল্লকমলারূঢ়াং ধ্যায়েত্তাং ভবগেহিনীম্।।


দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্র–এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। দুর্গাকল্প–এ আছে:
কার্তিকে শুক্লপক্ষেঽহনি ভৌমবারে জগৎপ্রসূঃ।
সর্বদেবহিতার্থায় দুর্বৃত্তশমনায় চ।।
আবিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ যুগাদৌ পরমেশ্বরী।।
-দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন।
কালবিবেক গ্রন্থে পূজার বিধান প্রসঙ্গে শূলপাণি লিখছেন:
কার্তিকোঽমলপক্ষস্য ত্রেতাদৌ নবমেঽহনি।
পূজয়েত্তাং জগদ্ধাত্রীং সিংহপৃষ্ঠে নিষেদূষীম্।।
-ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে সিংহপৃষ্ঠে সমাসীনা দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা করিবে।
জগদ্ধাত্রী পূজা তান্ত্রিক পূজা। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী – এই তিন দিন জগদ্ধাত্রীর পূজা হয়ে থাকে। তবে অনেকে নবমীর দিন তিন বার পূজা করে সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজা সম্পন্ন করেন। কোথাও কোথাও প্রথম বা দ্বিতীয় পূজার পর কুমারী পূজারও আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার ন্যায় জগদ্ধাত্রী পূজাতেও বিসর্জনকৃত্য বিজয়াকৃত্য নামে পরিচিত। এমনকি পুষ্পাঞ্জলি ও প্রণাম মন্ত্রসহ পূজার অনেক মন্ত্রও দুর্গাপূজার অনুরূপ।

জগদ্ধাত্রী পূজা বাঙালি হিন্দু সমাজের একটি বিশিষ্ট উৎসব হলেও, দুর্গা বা কালীপূজার তুলনায় এই পূজার প্রচলন অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে ঘটে। অষ্টাদশ শতকে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় তাঁর রাজধানী কৃষ্ণনগরে এই পূজার প্রচলন করার পর এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়।  যদিও দেবী জগদ্ধাত্রী যে বাঙালি সমাজে একান্ত অপরিচিত ছিলেন না, তার প্রমাণও পাওয়া যায়। শূলপাণি খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকে কালবিবেক গ্রন্থে কার্তিক মাসে জগদ্ধাত্রী পূজার উল্লেখ করেন। পূর্ববঙ্গের বরিশালে খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত জগদ্ধাত্রীর একটি প্রস্তরমূর্তি পাওয়া যায়। বর্তমানে এই মূর্তিটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ সংগ্রহশালার প্রত্নবিভাগে রক্ষিত।  কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বকালের আগে নির্মিত নদিয়ার শান্তিপুরের জলেশ্বর শিবমন্দির ও কোতোয়ালি থানার রাঘবেশ্বর শিবমন্দিরের ভাস্কর্যে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি লক্ষিত হয়। তবে বাংলার জনসমাজে কৃষ্ণচন্দ্রে পূর্বে জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। কেবল কিছু ব্রাহ্মণগৃহে দুর্গাপূজার পাশাপাশি জগদ্ধাত্রী পূজা অনুষ্ঠিত হত।

কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজা


কৃষ্ণনগর রাজবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা
নদিয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। কিংবদন্তী অনুসারে নবাব আলিবর্দির রাজত্বকালে মহাবদজঙ্গ রাজার নিকট থেকে বারো লক্ষ টাকা নজরানা দাবি করেন। নজরানা দিতে অপারগ হলে তিনি রাজাকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে (মতান্তরে মুঙ্গেরে) নিয়ে যান। মুক্তির পর নদীপথে কৃষ্ণনগরে প্রত্যাবর্তনের সময় ঘাটে বিজয়াদশমীর বিসর্জনের বাজনা শুনে তিনি বুঝতে পারেন সেই বছর দুর্গাপূজার কাল উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে। দুর্গাপূজার আয়োজন করতে না পেরে রাজা অত্যন্ত দুঃখিত হন। সেই রাতে দুর্গা জগদ্ধাত্রীর রূপে রাজাকে পরবর্তী শুক্লানবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী দুর্গার পূজা করার আদেশ দেন।অন্য এক মতে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা ১৭৬৬ সালে। কেউ কেউ আবার কৃষ্ণচন্দ্রের প্রপৌত্র গিরিশচন্দ্রকে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক মনে করেন। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দরজা জগদ্ধাত্রী পূজার সময় আজও খোলা থাকে। পূজা পুরনো প্রথা মেনে হয় শুধুমাত্র নবমী তিথিতে।
১৭৭২ সালে রাজবাড়ির দেখাদেখি কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রজারা জগদ্ধাত্রী পূজা শুরু করেন। বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত এই পূজা শুরু হয়েছিল ঘটে ও পটে। প্রথম দিকে স্থানীয় গোয়ালারা দুধ বিক্রি করে এই পূজার আয়োজন করতেন। ১৭৯০ সাল নাগাদ গোবিন্দ ঘোষ ঘটপটের পরিবর্তে প্রতিমায় জগদ্ধাত্রী পূজার সূচনা করেন। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল প্রায় সাড়ে সাতশো ভরি সোনায় গয়নায় দেবীপ্রতিমার অলংকারসজ্জা। কৃষ্ণনগরের বাসিন্দাদের মতে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা; তাঁর নিকট সকল মনোষ্কামনাই পূর্ণ হয়।
এছাড়া কৃষ্ণনগরের উল্লেখযোগ্য বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল প্রীতিসম্মেলনী, বালকেশ্বরী, মালোপাড়া, হাতারপাড়া, উকিলপাড়া, ষষ্ঠীতলা, বউবাজার, নেদেরপাড়া, বাঘাডাঙা, পাত্রমার্কেট, কৃষ্ণনগর স্টেশন চত্বর, বেজিখালি, চকেরপাড়া, বাগদিপাড়া, মাঝেরপাড়া, ঘূর্ণি, হরিজনপল্লি, তাঁতিপাড়া, কালীনগর ইত্যাদি। বর্তমানে কৃষ্ণনগরে বারোয়ারি জগদ্ধাত্রী পূজা হয় দুই শতেরও বেশি, যা জগদ্ধাত্রী পূজার জন্য বিখ্যাত চন্দননগর মহানগরের চেয়েও বেশি।

চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজা


পালপাড়া সর্বজনীন জগদ্ধাত্রী পূজা, চন্দননগর
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবর্তক ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। জানা যায়, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের ফরাসি সরকারের দেওয়ান। প্রায় আড়াইশো বছর আগে, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা। লক্ষ্মীগঞ্জ কাপড়েপট্টির জগদ্ধাত্রী পূজা চন্দননগরে দ্বিতীয় প্রাচীনতম পূজা। ১৭৬৮ সালে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পূজা প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চলের অপর দুটি পূজা হল লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা (স্থাপিত ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের (স্থাপিত ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ) পূজা। উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার – এই চার পূজাতেই সিংহের রং সাদা। উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড়ো জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল চন্দননগর বাগবাজার (স্থাপিত ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ), খলিসানী কলপুকুরধার, বউবাজার শীতলাতলা, খলিসানী বউবাজার, বাগবাজার চৌমাথা, বিদ্যালঙ্কার, পালপাড়া, বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল, বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা, হরিদ্রাডাঙা, হেলাপুকুরধার, নাড়ুয়া, কাঁটাপুকুর, কাঁটাপুকুর চৌমাথা, বোড়ো কালীতলা, বোড়ো পঞ্চাননতলা, বোড়ো চাঁপাতলা, বোড়ো দিঘির ধার, বোড়ো তালডাঙা ইত্যাদি।
দক্ষিণ চন্দননগরের বিখ্যাত জগদ্ধাত্রী পূজাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানকুণ্ডু সার্বজনীন, মানকুণ্ডু নতুনপাড়া, নিয়োগী বাগান, সার্কাস মাঠ, তেমাথা, অম্বিকা অ্যাথলেটিক ক্লাব, মরান রোড, গোন্দলপাড়া মনসাতলা, সাতঘাটা, গোন্দলপাড়া চারমন্দিরতলা, বেশোহাটা, লিচুতলা হাজিনগর, হাটখোলা দৈবকপাড়া, মনসাতলা, ভুবনেশ্বরীতলা, নোনাটোলা, বড়বাজার, পাদ্রিপাড়া, লালবাগান, ড্যুপ্লেক্সপট্টি, শ্রমিকপল্লি, সুভাষ জাগরণ সংঘ তেমাথা, অরবিন্দ সংঘ, বারাসত দক্ষিণ, বারাসত গেট। দক্ষিণ চন্দননগরের হালদারপাড়ার আদিপুজো অশ্বত্থতলার বুড়িমার পূজা নামে পরিচিত। এই পূজা লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি ও কাপড়েপট্টির পূজার সমসাময়িক বলে মনে করা হয়।

জয়রামবাটীর জগদ্ধাত্রী পূজা

বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ) সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তাঁর জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী। কিংবদন্তি অনুসারে, প্রতি বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। ওইবছর কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুজ্যে চাল নিতে অস্বীকার করেন। নৈবেদ্যদানে অসমর্থ হয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তাঁর স্বপ্নাদেশে ওই চালে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা বন্ধ করে দিতে চাইলে দেবী জগদ্ধাত্রী তাঁকে স্বপ্নাদেশে পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর প্রথম চার বছর পূজা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে; দ্বিতীয় চার বছর সারদা দেবীর নামে এবং তৃতীয় চার বছর তাঁর কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে। বারো বছর পর সারদা দেবী পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শোনা যায়, এই বারও জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি নিরস্ত হন।
জীবদ্দশায় প্রতি বছরই জগদ্ধাত্রী পূজায় উপস্থিত থাকতেন সারদা দেবী। পূজা পরিচালনার জন্য তিনি সাড়ে দশ বিঘার কিছু বেশি জমি দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে দিয়ে যান। ১৯১৯ সালে সারদা দেবী এই পূজায় শেষবার উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রয়াত হন।
প্রথম পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী আজও শুক্লা নবমীতে মূল পূজার পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে দিয়ে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার মতোই পূজার সঙ্কল্প হয় সারদা দেবীর নামে। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা থাকে। নবমীতে ষোড়শোপচারে পূজা, তিন বার চণ্ডীপাঠ ও মাতৃমন্দিরে দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়। দশমীর দিন দশোপচারে পূজা হয়। এই দিন সন্ধ্যারতির পর যাত্রাগানের আসর বসে। একাদশীর দিনও দশোপচারে পূজা ও বিসর্জনকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই দিন ধুনুচি নৃত্য, কর্পূরারতি, কনকাঞ্জলি প্রদান প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হয়। ধুনুচি নাচের পর বাদ্যঘণ্টা ও শোভাযাত্রা সহকারে মায়ের দিঘিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনে আশ্রমবাসী, অতিথি এবং গ্রামবাসী সকলে অংশ নেন। পূজা উপলক্ষে আশ্রমপ্রাঙ্গনে মেলাও বসে।

কোলকাতার জগদ্ধাত্রী পূজা:-

 দুর্গা ও কালীপুজোর তুলনায় দৌড়ে পিছিয়ে থাকলেও মহানগরীতে জগদ্ধাত্রী পুজোর রেওয়াজ রয়েছে৷ শুধু তাই নয় কৃষ্ণনগর আর চন্দনগরের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও ইদানিং এই পুজোর দিকেও নজর পড়েছে কলকাতাবাসীর৷ ফলে নতুন নতুন  বেশ কিছু বারোয়ারি পুজোর পাশাপাশি পুরনো বনেদি বাড়িতে এবং মঠ ও আশ্রমে এই পুজো হয়ে থাকে৷ উত্তর কলকাতার বিকে পালের বাড়ির পুজো ১৯০০ সালে  শুরু করেছিলেন বটকৃষ্ণ পাল৷ আবার মুক্তরামবাবু স্ট্রিটে দত্ত বাড়ির পুজোও বহু বছর ধরে চলে আসছে ৷ বরাহনগরে সত্যানন্দদেব প্রতিষ্ঠিত শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ আশ্রমে এবং ডানলপে ওঙ্কারনাথ দেবের প্রতিষ্ঠিত মহামিলন মঠেও নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো চলে৷ বারোয়ারি পুজোগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তর কলকাতার শ্যাম পার্কে স্কোয়ার অ্যাথলেটিক ক্লাবের পুজো, রাজবল্লভ পাড়া , বাগবাজার স্ট্রিটের পুজো, বেনিয়াটোলা লেনের পুজো , এসএন ব্যানার্জি রোডের ইযুথ কর্ণারের পুজো৷

     জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ জগৎ+ধাত্রী। অর্থাৎ জগতের (ত্রিভুবনের) ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)। ব্যাপ্ত অর্থে দুর্গা, কালী সহ অন্যান্য শক্তিদেবীগণও জগদ্ধাত্রী। তবে শাস্ত্রনির্দিষ্ট জগদ্ধাত্রী রূপের নামকরণের পিছনে রয়েছে সূক্ষ্মতর ধর্মীয় দর্শন।

তথ্যসূত্র :-
  1. Hindu Gods and Goddesses, Swami Harshananda, Sri Ramakrishna Math, Chennai, p. 123
  2. বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস সংকলিত ও সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা

  3. প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৭৭-৭৮

  4. কেন উপনিষদ, তৃতীয়-চতুর্থ খণ্ড

  5. প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯, পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭-এ উল্লিখিত শাস্ত্রউদ্ধৃতিগুলি দ্রষ্টব্য

  6. প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৭৯

  7. দেবদেবী ও তাঁদের বাহন, স্বামী নির্মলানন্দ, প্রণব মঠ, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৩০৩-০৫
  8. প্রবন্ধ জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃষ্ঠা ৮০
  9. শব্দকল্পদ্রুম ২য় খণ্ড, পরিশিষ্ট, পৃষ্ঠা ১৮২-৮৪

  10. হুতোমপ্যাঁচার নক্সা: বসুমতী কর্পোরেশন লিমিটেড (কলকাতা) সংস্করণ, পৃ. ২৫-২৬ ও ২৯

  11. পৌরাণিকা : বিশ্বকোষ হিন্দুধর্ম, প্রথম খণ্ড, অমলকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ফার্মা কেএলএম প্রাঃ লিঃ, পৃষ্ঠা ৫৬২

  12. হারাধন চৌধুরীর প্রতিবেদন দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে অতুলনীয়া কেন?, বর্তমান (রবিবার), ২ নভেম্বর, ২০০৮

  13. চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় কী দেখবেন, অরুণ মুখোপাধ্যায়, সাপ্তাহিক বর্তমান, ২৪ অক্টোবর, ২০০৯

  14. সারদা দেবীর জীবনীকার স্বামী গম্ভীরানন্দ পূজা প্রবর্তনের সময়কাল সম্পর্কে লিখেছেন, “এই জগদ্ধাত্রী পূজার কাল সম্বন্ধে নিঃসংশয় নহি। কেহ কেহ বলেন, ইহা ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ঘটনা।” (শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৫০ (পাদটীকা))

  15. শ্রীমা সারদা দেবী, স্বামী গম্ভীরানন্দ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০৪, পৃ. ৫০

  16. শ্রীশ্রীমা সারদা ও জগদ্ধাত্রী পুজো, স্বামী বলভদ্রানন্দ, সাপ্তাহিক বর্তমান, ২৪ অক্টোবর ২০০৯

Saturday, 5 November 2016

ছট পূজা

বাঙ্গালীর প্রধান উৎসব দুর্গা পূজার মতই বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রধান উৎসব ছট পূজা। বর্তমানে ছট পূজা আর বিহারী সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এখন বাঙ্গালী, মারোয়াড়ী, নেপালী সম্প্রদায়ের মানুষরাও পরিবারের মঙ্গল কামনার জন্য ছট পূজা করেন। ছট পূজা মূলত সূর্য দেবের পূজা। হিন্দু শাস্ত্রে সূর্যকে সৃষ্টির দেবতা হিসেবে আরাধনা করা হয়। ভগবত , পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের মতো বিভিন্ন গ্রন্থে সূর্যের উপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়। আর ভিন্ন মতে ছট হল ষষ্টির অপভ্রংশ। কার্তিক মাসের আমাবস্যার পড়ে ছট ব্রত পালন করা হয়। আরেক মতে সূর্য আর ষষ্টি হল ভাই বোন। সেই কারণেই ছটকে ছোট্টীমাইয়া বলা হয়। আর তাই ছোট্টীমাইয়ার পূজার প্রধান উপকরণ কুলা ও ডালার চাহিদা বাড়ে এই সময়টায়। 
ভারতবর্ষের হিন্দিভাষী হিন্দুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পূজা ছট্‌ পূজা। ছট্‌ অর্থাৎ ছটা বা রশ্মির পূজা। এই রশ্মি সূর্য থেকেই পৃথিবীর বুকে আসে। সুতরাং এই পূজা আসলে সূর্যদেবের পূজা। প্রত্যক্ষভাবে ‘ছট;-এর পূজা হলেও এই পূজার সঙ্গে জড়িত আছেন স্বয়ং সূর্যদেব, আছেন মা গঙ্গা এবং দেবী অন্নপূর্ণা। …

পৌরাণিক কাহিনিতে রয়েছে — বর্ষার আগমন ঘটেছে। কিন্তু বৃষ্টি তেমন হয়নি। চাষিদের মাথায় হাত। মাঠের ফসল মাঠেই মারা যাচ্ছে। মা অন্নপূর্ণা ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে থাকেন। সকল দেবতা মা অন্নপূর্ণার এহেন দুর্দশায় ব্যথিত। ঘরে ঘরে অন্নাভাব হাহাকার ওঠে। সূর্যের তাপ হ্রাস করে বাঁচার জন্য মা অন্নপূর্ণা সূর্যদেবের ধ্যান করতে শুরু করেন। তাতে হিতে বিপরীত হয়। সূর্যের প্রখর ছটায় মা অন্নপূর্ণা দিন দিন শ্রীভ্রষ্টা হয়ে ক্ষীয়মান হতে থাকেন। দেবলোকে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। দেবতারা সম্মিলিতভাবে সূর্যদেবের কাছে গেলে তিনি মা অন্নপূর্ণার এই দশার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। এবং বলেন, মা অন্নপূর্ণা যেন গঙ্গাদেবীর আশ্রয় নেন। সূর্যদেব আরও বলেন, অস্তগমনকালে গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠীতে এবং সপ্তমীর উদয়কালে মা অন্নপূর্ণা গঙ্গাদেবীর আশ্রয়ে থেকে উদীয়মান ছটা বা রশ্মিকে দেখে আমার স্তব বা ১২টি নাম উচ্চারণ করলে আমার স্মরণকারীকে সমস্ত পৃথিবী অন্নে পূর্ণ হতে থাকল। মা অন্নপূর্ণা আবার তাঁর শ্রী ফিরে পান।
তাই ছট্‌ পূজা বা ব্রত একাধারে সূর্যদেব, মা অন্নপূর্ণা ও গঙ্গাদেবীর পূজা। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বলা যায়, গঙ্গার জলে সেচ ব্যবস্থা ঠিক থাকলে অনাবৃষ্টিতেও খেত-খামার অন্নে পূর্ণ হয় এবং স্বাভাবিকভাবে মনুষ্যসমাজে খাওয়া-পরার অভাব থাকে না। এই ব্রত পালনে সূর্যদেবের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি আমাদের জীবনে যেমন বিঘ্ননাশক, দুঃখনাশক, তেমনি সুখদায়ক ও অর্থ-বৈভবদায়ক।

Monday, 31 October 2016

অন্নকূট

‘সর্ব ধর্মান পরিত্যাজ মা মে কং স্মরণং ভজ।’

                                                                                                 শ্রীমদ্ভগবত গীতা



শ্রীমদ্ভগবত গীতার গোপন শ্রেষ্ঠ বাণী ‘সর্ব ধর্মান পরিত্যাজ মা মে কং স্মরণং ভজ।’ এ কথার আলোকে শরতের ঠিক মাঝামাঝি কার্তিক মাস, এ সময় ব্রজবাসীরা এক বিশেষ অনুষ্ঠানের অয়োজন করে। যা গোবর্দ্ধন পূজা ও অন্নকূট মহোৎসব নামে খ্যাত। আজ গোবর্দ্ধন পূজা অন্নকুট মহোৎসব। শ্রীমদ্ভগবত গীতার দশম স্কন্ধের নবম ও দশম অধ্যায়ে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত বশ্যতা স্বীকার স্বরূপ দাস বন্ধন লীলা বর্ণিত হয়েছে। যা আসল পুরাণ শ্রীমদ্ভগবতে বিধৃত লীলাদির প্রভূত রস আস্বাদন করেছেন বৈষ্ণব আচার্যগণ। লীলাপুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভৌম লীলায় অনেক চমকপ্রদ লীলা প্রদর্শন করেন।


ইন্দ্র বর্ষার দেবতা। চাষ করতে যেহেতু জলের প্রয়োজন হয়, তাই ইন্দ্রকে তুষ্ট করার জন্য মহারাজ নন্দ-সহ বৃন্দাবনের গোপেরা ইন্দ্রযজ্ঞ করতেন। কৃষ্ণ সর্বজ্ঞ। এমন যজ্ঞের কথা তাঁর কর্ণগোচর হল। তিনি পিতা নন্দর কাছে বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কৃষ্ণ তখন বালক। কিছু বুঝবে না মনে করে নন্দ চুপ করে থাকলেন। কিন্তু নাছোড়বান্দা কৃষ্ণকে বলতেই হল যজ্ঞের কথা। নন্দ বললেন যে, যেহেতু ইন্দ্র বৃষ্টির দেবতা, শস্য উৎপাদন করতে বৃষ্টি লাগে, বৃন্দাবনবাসী এবং গবাদিপশুসকল শস্য খেয়ে জীবনধারণ করে - সেইজন্য ইন্দ্রের পূজো করা কর্তব্য।


 সব শুনে কৃষ্ণ নন্দরাজকে এই বলে বোঝালেন যে,
 "বাবা, সমুদ্রের মাঝেও বৃষ্টি হয়। সেখানে কেউ ইন্দ্র পূজা করেন না। বহু প্রাচীন এই আচার-বিচার লৌকিকতা সংস্কার বহুবিধ নিয়ম নীতির মধ্য দিয়ে এই সনাতন ধর্ম। মত এবং স্তর ভেদে বিভিন্ন জনে বিভিন্নভাবে যার যার কর্ম করে যাচ্ছে। কেউ শাখায় বসে, কেউ পাতায় বসে, কেউবা কান্ড ঘেঁসে’ আবার কেউ কেউ মূল শিকড়ের সন্ধানে নীরব নিথরভাবে জীবন যাপন করছেন। মূল সত্যকে জানাই হচ্ছে ধর্ম। আমরা চাঁদের আলোতে আলোকিত হই। কিন্তু চাঁদ কোথা থেকে আলোকিত, তা জানার চেষ্টা করি না। যারা চাঁদের আলোর উৎসের সন্ধান জেনেছেন তারাই প্রকৃত জ্ঞানী। সেই সব জ্ঞানীরা মহান আলোর উৎসের বেদীমূলে নিজকে উৎসর্গ করে ধন্য হয়েছেন। আজ অনেকেই শাস্ত্রীয় পথে না গিয়ে লৌকিক আচার পালন করছেন। লৌকিক আচার পালন করে বর্তমান আনন্দ লাভ হতে পারে, তাতে পারমার্থিক লাভ নেই। আমাদের জীবিকা যে গোপালন, গাভী বর্ধনের জন্য আমরা গোবর্ধনের কাছে ঋণী। ইন্দ্রের কাছে নয়। চলো আমরা গোবর্ধনের পূজা করি।"
প্রত্যেক দেবতারই কাজ নির্দিষ্ট করা আছে এবং তারা সেই কাজ যথাযথভাবেই সম্পাদন করে থাকেন। নিজেদের কাজ ঠিকঠাক না করলে প্রত্যেককেই কর্মফল ভোগ করতে হবে। তাই আলাদা করে ইন্দ্রযজ্ঞ করার কোন দরকার নেই। তার থেকে গাভীসকলকে – যা জীবনধারণের অবলম্বন, গিরিরাজ গোবর্ধন ও বৃন্দাবনের অরণ্যরাজিদের – যাদের সাথে গভীর সম্পর্ক এবং সকল ব্রাহ্মণ ও ক্ষুধার্তদের ভালভাবে সেবা করানোই উচিত কাজ হবে। শেষপর্যন্ত কৃষ্ণের কথায় সকলে সম্মত হলেন। ইন্দ্রের জন্য যেসকল উপকরণের আয়োজন করা হয়েছিল তাই দিয়ে তৈরী হল শতাধিক নানানধরণের খাবার। তারপর সেই খাবার দিয়ে গাভী, গোবর্ধন পর্বত, অরণ্য, ব্রাহ্মণ, ক্ষুধার্তদের ভাল করে ভোজন করানো হল – যা ‘অন্নকূট’ নামে পরিচিত।
এদিকে ইন্দ্রযজ্ঞ তো আর হল না। কিন্তু ইন্দ্রও ছেড়ে দেবার পাত্র নন। রুষ্ট হয়ে তিনি প্রবল বৃষ্টি নামালেন। বৃন্দাবন ভেসে গেল, সকলের খুবই দুরবস্থা। এই অবস্থায় কৃষ্ণ গোবর্ধন পর্বতকে হাতে তুলে নিয়ে ছাতার মত বৃন্দাবনের মাথার ওপর ধরে রাখলেন, সকলের প্রাণরক্ষা হল। এমনভাবে দিনসাতেক অতিবাহিত হওয়ার পর অবশেষে ইন্দ্র হার স্বীকার করে কৃষ্ণের সঙ্গে সন্ধি করলেন।
সেই থেকে শুরু হল গিরিগোবর্ধন পূজো আর অন্নকূট উৎসব, যা সাধারণত কার্তিক মাসের অমাবস্যার পরেরদিন পালন করা হয়। কোন কোন বছরে তিথি অনুযায়ী অমাবস্যার দুদিন পরে অনুষ্ঠিত হয়। আজ তেমনই এক দিন। এটি প্রধানত বৈষ্ণবদের উৎসব। কথিত আছে, গোবর্ধন পাহাড়ের রূপ ধরে কৃষ্ণই ভোজন করেছিলেন।

 শ্রীল সনাতন গোস্বামীর মতে, দাসবন্ধন লীলাটি হয়েছিল দীপাবলী উৎসবের দিন। তখন শ্রীকৃষ্ণের বয়স ছিল ন্যুনধিক তিন বছর চার মাস। শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী পাদের মতে, শ্রীকৃষ্ণ গোকূলে ছিলেন তিন বছর চার মাস। এর পর নন্দ মহারাজ ও ব্রজবাসীবৃন্দ যখন বৃষ্টি কামনায় বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র পূজা করবে, তখন বালক শ্রীকৃষ্ণ সে পূজায় বাধা প্রদান করেন।
 অন্নকষ্ট. অন্নকূট [কূ]. অন্নকৃচ্ছ্র. অন্নক্লেশ. অন্নগ্রহণ [ণ ]. অন্নচিন্তা. অন্নছত্র. অন্নজল. অন্নজীবী [জী বী]. অন্নত্যাগ. অন্নত্যাগী. অন্নদা 'দুর্গা', তু০ অন্যদা 'সমায়ন্তর'. অন্নদাতা ...... অর্হণ, অর্হণা [ণ] 'পূজা'. অর্হণিত
 

ভ্রাতৃদ্বিতীয়া

"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা

যুমনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা

 যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে  যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা নিয়ে  আমার ভাই হোক অমর॥"

ভাইফোঁটা তেরো পার্বনের মধ্যে পরে কি না আমার ঠিক জানা নেই ,কিন্তু এটি একটি মিষ্টি  উৎসব। কারণ, ভাইফোঁটা কোন প্রচলিত পূজা-পার্বণ নয়, বাঙ্গালীর ঘরে ‘ভাইফোঁটা’ হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দময়, নির্মল, একটি অনুষ্ঠান । ভাই-বোনের মধ্যেকার অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য বোনের প্রার্থণাই ‘ভাইফোঁটা’ কে মহিমান্বিত করেছে। প্রথা অনুযায়ী শুক্লাতিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপূজার দুই দিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালী হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিন উদযাপিত হয়। মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব।



 ভাইফোঁটার এই বিশেষ দিনটিতে ভাই কিংবা দাদাদের কপালে বোন অথবা দিদিরা দই  ও চন্দনের মিশ্রণে ফোঁটা দেয় ও ভাইয়ের দীর্ঘ আয়ু কামনা করে৷মিষ্টি ও উপহার সহযোগে ভাই এবং বোনের কাছে ভাইফোঁটা অত্যন্ত বিশেষ দিন৷
 ঋকবেদে আছে, মৃত্যুদন্ডদাতা যম ও তাঁর বোন যমুনা হচ্ছে সূর্য্যের যমজ সন্তান, অর্থাৎ তারা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল অদর্শনে থেকে বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাই যমকে একটু দেখার। ভাইকে নিমন্ত্রণ করতেই ভাই যমরাজ বোনের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। ভাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন শেষে ভাইয়ের জন্য মন ব্যাকুল হতেই বোন যমুনা ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন, ভাই যমরাজ খুব প্রীত হন বোনের এই আকুলতা দেখে। বোনকে নিশ্চিন্ত করতে বোনের ডাক পেলেই আবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন। যমুনা তার ভাইয়ের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে খুশীতে আনন্দাশ্রু ফেলেন। সেই থেকেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনা উৎসবের প্রচলন। সেই থেকেই ভাইয়ের কল্যানে অনুষ্ঠিত পরবটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন বাঙ্গালীদের মাঝে ভাইফোঁটা, নেপালে ‘ভাই টীকা’ অথবা ভারতের নানা প্রদেশে ‘ভাইদুজ’ নামে পালিত হয়। রাখীবন্দনও ভাইফোঁটার আরেক সংস্করণ।
মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের সমাজ তৈরী হয় প্রথমে ঘর থেকে। বাবা-মা, ভাই বোন দিয়ে যে পরিবার শুরু হয়, সেই ছোট পরিবারটিই সময়ের সাথে সাথে আত্মীয়তার বন্ধন বিস্তৃত করে, ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশী, প্রতিবেশী পেরিয়ে পাড়া, গ্রাম ছাড়িয়ে একদিন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। যে ভাইয়ের একটি মাত্র বোন ছিল, চলার পথে সে আরও কত বোন, দিদি, আপুর দেখা পায়। যে মেয়েটি শুরুতে একটি ভাইয়ের আদর পেয়ে বড় হচ্ছিল, সেই মেয়েটিই জীবন চলার বাঁকে বাঁকে কত নতুন ভাই, দাদার দেখা পায়। এভাবেই সম্পর্ক বাড়তে থাকে, এবং একসময় অচেনা যে কারো সাথেই ‘ভাই’ বা ‘বোন’ সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। ভাই-বোন সম্পর্কে জাত, ধর্ম, গোষ্ঠীর বিভিন্নতা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এই সম্পর্কে কোন স্বার্থ-দ্বন্দ্ব থাকেনা, ভাই-বোন সম্পর্কে কোন বিরোধ থাকেনা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সারা বাংলায় ‘রাখী বন্ধন’ উৎসব হয়েছিল। কবিগুরু কোন আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও ‘রাখীবন্ধন’ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, মারাঠির মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকলেই ভাই, প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল স্নেহময়ী বোন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, কত অচেনা মায়ের ছেলেকে ‘ভাইয়ের স্নেহে’ শত্রুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে বাংলার বোনেরা। এভাবেই যুগে যুগে ভাই-বোনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। ভাই বাইরে যতই প্রভাবশালী হোক, বোনের কাছে এলেই শিশু হয়ে যায়, বোন বয়সে বড়ই হোক অথবা ছোট হোক, মায়ের পরেই স্নেহময়ীর পদটি তার দখলে চলে যায়। ভাইয়ের কল্যান কামনায় বোন সবসময় ঈশ্বরের কাছে তার দুই হাত তুলে রাখে।


আমার নিজের কোন দিদি বা বোন নেই ,কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার মামাতো দিদি সন্তিদিদির  কাছে ভাইফোঁটা নিয়ে এসেছি, বস্তুত দিদির অভাব কোনদিন অনুভব করিনি, আজ কয়েকবছর হল দিদি চলে  গেছে অমৃতলোকে ,..........

আমার বাবা একটা কথা বলতেন,তখন মানে বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি , বলতেন  "সবার চারিদিকে একটা বৃত্ত আছে,যা চোখে দেখা যায় না ,এই বৃত্তটা যত বড়ো করবে তত ভালো থাকবে, আর এই বৃত্তটাকে ছোট  চাইলে ,এটা ছোট হতে হতে একদিন তোমাকে একা করে দেবে। "

আমি সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে গেছি আমার বৃত্তটাকে বড়ো করতে, যার ফলশ্রুতি আমার অনেক ভাই,অনেক বোন,অনেক দাদা,দিদি,সময় বা সুযোগের অভাবে হয়তো সবার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমার চরম দুঃসময়ে আমি অনুভব করেছি তাঁদের দীর্ঘশ্বাস, আমার ব্যাথায় তাঁদের সমব্যাথীতা। 
আগামীকাল  ভ্রাতৃদ্বিতীয়া,  প্রার্থনা করি ,জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে ,এই দিনটা হোক বিশ্ব ভাতৃত্বের। সীমন্তিনী মুখার্জী,নাফিসা বেগম,এরিথ ডিসুজা রা সবাই হোক আমার স্নেহের বোন। 
ফটো :- এই সময় সৌজন্যে 


"মিষ্টি বোন ভালো থাকিস "------ দাদা

Thursday, 27 October 2016

ভুত চতুর্দশী

আঁধারে হাওয়ার শিরশিরানি, ...., ভূত দেখে রক্ত হিম !

সব ব্রহ্মদত্যি, পেত্নী, শাঁখচুন্নীর আজকে  পার্টি টাইম।।


আজ ভুত চতুর্দশী,আমাদের ছেলেবেলায় আজকের দিনটা ছিল খুব ভয়ঙ্কর, আমি আর দিদি মিলে সকালবেলা সারা বাড়ি ঘুরে চোদ্দশাক তুলতাম , তারপর মাটি দিয়ে প্রদীপ বানাতাম অবশ্য প্রদীপ বানানোর মূল কারিগর ছিল দিদি,আমি হেল্পার মাত্র ,প্রদীপ বানিয়ে রোদে শুকোতে দিয়ে ,জলকাদা ঘাঁটার জন্য মায়ের হাতে একপ্রস্থ মার্ খেয়ে এই পর্বের সমাপ্তি ঘটতো।    এরপর সন্ধ্যেবেলা,......... সে এক ভয়ানক ব্যাপার ,......... আমাদের বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল একটা ঝাঁকড়া শেওড়াগাছ ,ঘন অন্ধকারে শেওড়া ঝোপের মধ্যে ঝিকমিক করতো জোনাকি, আমরা নিশ্চিত ছিলাম,ওই শেওড়া গাছে পেত্নীরা থাকে, শেওড়াতলায় প্রদীপ দেবার সময় অপরদিকে তাকাতাম না ,যদি পেত্নীদের দাদা চোখাচোখি হয়ে যায় ,,,,,,,,,,! বাড়ীর উত্তরদিকে জুড়ে ছিল বিশাল বাঁশবাগান,হালকা হাওয়ায় আর কটকট করে আওয়াজ হতো, হ্যারিকেনের আলোয় গুটিসুটি মেরে বসে আমি আর দিদি ফিসফিস করে বলাবলি করতাম,'ওই শোন্  ,ভূতেদের আওয়াজ ,সবাই এসেগেছে,................ '
  আমাদের 'অপু -দুগ্গা ' জুটি ভেঙে দিদি চলে গেছে অমৃতলোকে,....... আমার মেয়ে তিতলি যখন ৬ বছরের কার্তিকী অমাবস্যার দিনে ওকে আমাদের ছোটবেলার গল্পটা বলেছিলাম, ও তো শুনে খুব খুশি, তারপর থেকে আমি আর তিতলী ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরের সব ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালাতাম, তিতলী ছিলো বেশ সাহসী,আমার আর দিদির মতো ভীতুরাম নয় , আমার মতো আধবুড়ো লোকের এই পাগলামী দেখে বাড়ির অন্যান্যরা (আমার স্ত্রী,ভাইয়েরা ,ভাইয়ের স্ত্রী) হয়তো একটু বিরক্তই হতো, কিন্তু এই পাগলামির মধ্য  দিয়েই আমি আমার ছেলেবেলা,আমার আর দিদির অপু-দুগ্গা জুটিকে ছুঁই যাবার চেষ্টা করতাম। ...................

আজ সেই ভূত চতুর্দশী, আজ আমি একা ,তিতলীও চলে গেছে চাঁদের দেশে,ফুলের দেশে ,............ আমি বাগানে একা বসে আছি, মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে মাটি দিয়ে  প্রদীপ বানাচ্ছে।............... একটা আধবুড়ো লোক আর একটা ছোট মেয়ে একটা থালায় ১৪ তা প্রদীপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে শেওড়াতলায়,বাঁশবাগানে,পুকুরঘাটে ,,..............!!! আমার আজ আর দীপাবলি নেই ,'দীপ নিবে গেছে মম নিশীথ সমীরে'


"অসতো মা সদ্‌গময়

তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যোর্মামৃতং গময়।

আবিরাবীর্ম এধি।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং

তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।"

আমাকে তমসা থেকে আলোর দিকে নিয়ে  চলো,.......

আমাকে আলোর পথ দেখাও ,.......................

আমাকে এ অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও ,.....


 বাংলা পঞ্জিকামতে আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিকে ভূত চতুর্দশীও বলে।
কালিপুজো/দীপাবলি/দিওয়ালির একদিন আগে সাধারনত ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়।
এই দিনে চৌদ্দ শাক, চৌদ্দ পিদিম জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের অতৃপ্ত আত্মাদের তুষ্ট করে, অশুভ শক্তিকে দূর করার রেওয়াজ আছে ।  দীপাবলির আগের দিন ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত। এই দিন চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালান হয় দীপাবলীর সূচনা হয়েছিল বর্ষান্তে কীটের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। কীটের উপদ্রবে হৈমন্তিক ফসল নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য এক সঙ্গে অনেক দীপ জ্বালিয়ে কীট নির্মূল করার জন্য মানুষ এটা করেছিল ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের পর যখন বাঙলায় পূর্ব ভারতে তন্ত্রের স্রোত বইতে শুরু করল তখন তারা তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ রাত হিসেবে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যাকে বেছে নিয়েছিল। গোটা বছরের সব চেয়ে অন্ধকার হচ্ছে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যা।
এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে অমানিশায় যুঝবার জন্য সেকেলের মানুষ, বিশেষ করে বাঙলার মানুষ আলোক সজ্জা করেছিল। ঘন ঘোর তমসার  বিরুদ্ধে যুঝবার জন্য এই দীপাবলী।
  চৌদ্দ শাক খেয়ে দিনটি পবিত্র ভাবে পালন করে সন্ধ্যায়
মৃত পূর্বপুরুষ দের উদ্দ্যেশে সাতটি প্রদীপ
দেওয়া হয়। একে "যম প্রদীপ" বলে। বলা হয় এতে যমরাজ প্রসন্ন হয়ে মৃত ব্যাক্তির
আত্মাকে মুক্ত করেন । সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দের মতো হিন্দুরাও বিশ্বাস করে এই দিনটি তে মৃত আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসেন। যাই হোক ভূত চতুর্দশীর একটি অন্য রকম অর্থ দাড়ায় । ভূত
চতুর্দশীর পর দিন দীপান্বিতা অমাবস্যা।
মহাশক্তি মা কালীর পূজার দিন । আমাদের এই দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি। আকাশ, ভূমি, জল, অনল, পবন.........।।
। দেহান্তে শ্মশানে দেহ দাহ হলে এই শরীর
পঞ্চভূতে বিলীন হয় । সুতরাং এই পঞ্চভূতের শরীর কে নশ্বর জ্ঞানে এই দিনটি পবিত্র ভাবে থেকে চৌদ্দ শাক ভক্ষণ করে, সন্ধ্যায় ধর্মরাজের নামে প্রদীপ উৎসর্গ করে পর দিবস মা কালীর উপাসনায় ব্রতী হবার শিক্ষে দেয়। তাই
এই দিন ভূত চতুর্দশী নামে খ্যাত । প্রেতাত্মার কথা বলতে এখানে দেহের নশ্বর মূর্তির কথাই তুলে ধরা হয়েছে ।
সনাতন ধর্ম বা ভারতীয় আঞ্চলিকতায়  বিভীন্ন অশরীরি আত্মার কথা পাওয়া যায় তেমনী পুরাণ গুলোতে ভূত পিশাচ বেতাল ডাকিনী ইত্যাদি রকম নাম পাওয়া যায় । সকল পূজার পূর্বে ভূতের নামে পূজা দিয়ে তাদের তারাতে হয় নাহলে পূজায় বিঘ্ন ঘটে ।
ভূত কে বিস্বাস না করার কিছু নেই কারণ, সকল আত্মাই স্বর্গ বা নরকে যেতে পারে না । বিভীন্ন কারণে তারা পৃথিবীতে থেকে যায় । কেউ বা অতৃপ্ততার জন্য কেউবা অপঘাতে মৃত্যুর জন্য । ভূত যোনীতে থাকা আত্মারা পৃথিবীতে থেকেও নরক যন্ত্রনা ভোগ করে । যখন তারা এই পৃথিবীর মানুষদের সুখে থাকতে দেখে তখন তারা তাদের সুখকে বিঘ্ন ঘটাতে চায় ।
কিন্তু মনে রাখতে হবে টিভি সিনেমার ভূত আর বাস্তব ভূত একদম আলাদা । কারণ, ভূত কারো ক্ষতি করতে পারে না, মানুষ ভূত কে অনুভব করে নিজেদের মধ্যই একটা চিত্র তৈরী করে নেয় আর তার বর্ণনা দেয় । আপনাদের অবগতির জন্য বলতে হচ্ছে, পরমাণুর ১০লক্ষ ভাগের সমান একটি আত্মা সুতরাং তার কোন দেহ বা রুপ চর্মচক্ষুতে দেখা অসম্ভব ।
আজকের এই চতুর্দশীকে পশ্চিম ভারতের লোকেরা নরক চতুর্দশী বলে, বাঙলায় ভুত চতুর্দশী। এই দিন চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালান হয়, এর অর্থ পরের দিন ভালো করে আলো জ্বালব, অন্ধকারে আলোকসম্পাত করবো। আসলে এর অন্তরনিহিত অর্থ হল - চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালিয়ে শর- রিপু অষ্ট - পাশ কে দূর করা, নিজের ভাব লোকে আলোক উজ্জ্বল করা।

 আমাদের ভূত চতুর্দশীর বিদেশি নাম “হ্যালোউইন”। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় হ্যালোউইন। `হ্যালোউইন`কে পৃথিবীর কোথাও কোথাও `অল হ্যালোস ইভ`ও বলা হয়। অল সেন্টস ডে-র সন্ধেবেলা অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শেষ দিনে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় হ্যালোউইন। কুমড়ো দিয়ে গা ছমছম লন্ঠন জ্বালিয়ে ভূতুড়ে পোষাকে কস্টিউম পার্টিতে `হ্যালোউইন` উত্সবে মেতে ওঠে সবাই। উদ্দেশ্য অতৃপ্ত আত্মাদের বিদায় জানানো। অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতেই এই `হ্যালোউইন`। বলতে গেলে অনেকটা ভূত চতুর্দশীর মতই।
বলা হয় এদিন মৃত প্রেতাত্মারা পৃথিবীতে আসেন। এটা হিন্দুদের "হ্যালুইন উৎসব" । বিদেশে হ্যালুইন উৎসব পালন করা হয় মিষ্টিকুমড়োর ওপরের অংশ কেটে সমস্ত
বের করে মিষ্টিকুমড়োর মধ্যে চোখ মুখ
আঁকিয়ে তার মধ্যে মোমবাতি জালিয়ে রাখা হয়।
photo courtesy: azulreceptionhall.com

মানা হয় এতে প্রেতাত্মারা খুশী হন। এছাড়া এদিন ভূতের সাজসজ্জা সেজে আনন্দ উৎসব করা হয়। আমাদের  উৎসব একেবারে অন্য নিয়মে।
 অনেক অমিল । তারা চৌদ্দ শাকও খায় না।চৌদ্দ পিদিমও জ্বালায় না । আমাদেরটা তিথি মেনে হবেই মানে কালীপুজোর ঠিক আগের দিনে আর তাদেরটা ইংরেজী ক্যালেন্ডারের নির্দ্দিষ্ট দিনে মানে প্রতিবছর ৩১ শে অক্টোবর। শুধু মিল একটাই যে এবছর দুটোই কৃষ্ণপক্ষে পড়েছে।