"ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা
যুমনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দি আমার ভাইকে ফোঁটা
যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা নিয়ে আমার ভাই হোক অমর॥"
ভাইফোঁটা তেরো পার্বনের মধ্যে পরে কি না আমার ঠিক জানা নেই ,কিন্তু এটি একটি মিষ্টি উৎসব। কারণ, ভাইফোঁটা কোন প্রচলিত পূজা-পার্বণ নয়, বাঙ্গালীর ঘরে ‘ভাইফোঁটা’
হচ্ছে সবচেয়ে আনন্দময়, নির্মল, একটি অনুষ্ঠান । ভাই-বোনের মধ্যেকার
অনিন্দ্যসুন্দর সম্পর্ক ঘিরেই প্রচলিত হয়েছে এই উৎসবটি। ভাইয়ের মঙ্গল
কামনায় ঈশ্বরের কাছে বোনের আকুতি, ভাইয়ের সাফল্য, দীর্ঘায়ু লাভের জন্য
বোনের প্রার্থণাই ‘ভাইফোঁটা’ কে মহিমান্বিত করেছে। প্রথা অনুযায়ী
শুক্লাতিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদযাপিত হয়। এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান। কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয়া তিথিতে (কালীপূজার দুই দিন পরে) এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাঙ্গালী হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের ২য় দিন উদযাপিত হয়। মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে। পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব।
ঋকবেদে আছে, মৃত্যুদন্ডদাতা যম ও তাঁর বোন যমুনা হচ্ছে সূর্য্যের যমজ সন্তান, অর্থাৎ তারা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল অদর্শনে থেকে বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাই যমকে একটু দেখার। ভাইকে নিমন্ত্রণ করতেই ভাই যমরাজ বোনের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। ভাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন শেষে ভাইয়ের জন্য মন ব্যাকুল হতেই বোন যমুনা ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন, ভাই যমরাজ খুব প্রীত হন বোনের এই আকুলতা দেখে। বোনকে নিশ্চিন্ত করতে বোনের ডাক পেলেই আবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন। যমুনা তার ভাইয়ের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে খুশীতে আনন্দাশ্রু ফেলেন। সেই থেকেই ভাইয়ের মঙ্গল কামনা উৎসবের প্রচলন। সেই থেকেই ভাইয়ের কল্যানে অনুষ্ঠিত পরবটি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন বাঙ্গালীদের মাঝে ভাইফোঁটা, নেপালে ‘ভাই টীকা’ অথবা ভারতের নানা প্রদেশে ‘ভাইদুজ’ নামে পালিত হয়। রাখীবন্দনও ভাইফোঁটার আরেক সংস্করণ।
মানুষ সামাজিক জীব। আমাদের সমাজ তৈরী হয় প্রথমে ঘর থেকে। বাবা-মা, ভাই বোন দিয়ে যে পরিবার শুরু হয়, সেই ছোট পরিবারটিই সময়ের সাথে সাথে আত্মীয়তার বন্ধন বিস্তৃত করে, ঘর থেকে বেরিয়ে প্রতিবেশী, প্রতিবেশী পেরিয়ে পাড়া, গ্রাম ছাড়িয়ে একদিন সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে। যে ভাইয়ের একটি মাত্র বোন ছিল, চলার পথে সে আরও কত বোন, দিদি, আপুর দেখা পায়। যে মেয়েটি শুরুতে একটি ভাইয়ের আদর পেয়ে বড় হচ্ছিল, সেই মেয়েটিই জীবন চলার বাঁকে বাঁকে কত নতুন ভাই, দাদার দেখা পায়। এভাবেই সম্পর্ক বাড়তে থাকে, এবং একসময় অচেনা যে কারো সাথেই ‘ভাই’ বা ‘বোন’ সম্পর্ক তৈরী হয়ে যায়। ভাই-বোন সম্পর্কে জাত, ধর্ম, গোষ্ঠীর বিভিন্নতা কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এই সম্পর্কে কোন স্বার্থ-দ্বন্দ্ব থাকেনা, ভাই-বোন সম্পর্কে কোন বিরোধ থাকেনা। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় সারা বাংলায় ‘রাখী বন্ধন’ উৎসব হয়েছিল। কবিগুরু কোন আন্দোলনে সরাসরি যোগ না দিলেও ‘রাখীবন্ধন’ উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। সেদিন হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, মারাঠির মধ্যে কোন ভেদাভেদ ছিল না। সকলেই ভাই, প্রতিটি ঘরে ঘরে ছিল স্নেহময়ী বোন। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, কত অচেনা মায়ের ছেলেকে ‘ভাইয়ের স্নেহে’ শত্রুর আড়ালে রাখার চেষ্টা করেছে বাংলার বোনেরা। এভাবেই যুগে যুগে ভাই-বোনের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়েছে। ভাই বাইরে যতই প্রভাবশালী হোক, বোনের কাছে এলেই শিশু হয়ে যায়, বোন বয়সে বড়ই হোক অথবা ছোট হোক, মায়ের পরেই স্নেহময়ীর পদটি তার দখলে চলে যায়। ভাইয়ের কল্যান কামনায় বোন সবসময় ঈশ্বরের কাছে তার দুই হাত তুলে রাখে।
আমার নিজের কোন দিদি বা বোন নেই ,কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমার মামাতো দিদি সন্তিদিদির কাছে ভাইফোঁটা নিয়ে এসেছি, বস্তুত দিদির অভাব কোনদিন অনুভব করিনি, আজ কয়েকবছর হল দিদি চলে গেছে অমৃতলোকে ,..........
আমার বাবা একটা কথা বলতেন,তখন মানে বুঝিনি, এখন বুঝতে পারি , বলতেন "সবার চারিদিকে একটা বৃত্ত আছে,যা চোখে দেখা যায় না ,এই বৃত্তটা যত বড়ো করবে তত ভালো থাকবে, আর এই বৃত্তটাকে ছোট চাইলে ,এটা ছোট হতে হতে একদিন তোমাকে একা করে দেবে। "
আমি সারাজীবন ধরে চেষ্টা করে গেছি আমার বৃত্তটাকে বড়ো করতে, যার ফলশ্রুতি আমার অনেক ভাই,অনেক বোন,অনেক দাদা,দিদি,সময় বা সুযোগের অভাবে হয়তো সবার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়ে ওঠে না, কিন্তু আমার চরম দুঃসময়ে আমি অনুভব করেছি তাঁদের দীর্ঘশ্বাস, আমার ব্যাথায় তাঁদের সমব্যাথীতা।
আগামীকাল ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, প্রার্থনা করি ,জাতি বর্ণ ধর্ম নির্বিশেষে ,এই দিনটা হোক বিশ্ব ভাতৃত্বের। সীমন্তিনী মুখার্জী,নাফিসা বেগম,এরিথ ডিসুজা রা সবাই হোক আমার স্নেহের বোন।
![]() | |||
ফটো :- এই সময় সৌজন্যে |
"মিষ্টি বোন ভালো থাকিস "------ দাদা
No comments:
Post a Comment