Thursday, 27 October 2016

ভুত চতুর্দশী

আঁধারে হাওয়ার শিরশিরানি, ...., ভূত দেখে রক্ত হিম !

সব ব্রহ্মদত্যি, পেত্নী, শাঁখচুন্নীর আজকে  পার্টি টাইম।।


আজ ভুত চতুর্দশী,আমাদের ছেলেবেলায় আজকের দিনটা ছিল খুব ভয়ঙ্কর, আমি আর দিদি মিলে সকালবেলা সারা বাড়ি ঘুরে চোদ্দশাক তুলতাম , তারপর মাটি দিয়ে প্রদীপ বানাতাম অবশ্য প্রদীপ বানানোর মূল কারিগর ছিল দিদি,আমি হেল্পার মাত্র ,প্রদীপ বানিয়ে রোদে শুকোতে দিয়ে ,জলকাদা ঘাঁটার জন্য মায়ের হাতে একপ্রস্থ মার্ খেয়ে এই পর্বের সমাপ্তি ঘটতো।    এরপর সন্ধ্যেবেলা,......... সে এক ভয়ানক ব্যাপার ,......... আমাদের বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল একটা ঝাঁকড়া শেওড়াগাছ ,ঘন অন্ধকারে শেওড়া ঝোপের মধ্যে ঝিকমিক করতো জোনাকি, আমরা নিশ্চিত ছিলাম,ওই শেওড়া গাছে পেত্নীরা থাকে, শেওড়াতলায় প্রদীপ দেবার সময় অপরদিকে তাকাতাম না ,যদি পেত্নীদের দাদা চোখাচোখি হয়ে যায় ,,,,,,,,,,! বাড়ীর উত্তরদিকে জুড়ে ছিল বিশাল বাঁশবাগান,হালকা হাওয়ায় আর কটকট করে আওয়াজ হতো, হ্যারিকেনের আলোয় গুটিসুটি মেরে বসে আমি আর দিদি ফিসফিস করে বলাবলি করতাম,'ওই শোন্  ,ভূতেদের আওয়াজ ,সবাই এসেগেছে,................ '
  আমাদের 'অপু -দুগ্গা ' জুটি ভেঙে দিদি চলে গেছে অমৃতলোকে,....... আমার মেয়ে তিতলি যখন ৬ বছরের কার্তিকী অমাবস্যার দিনে ওকে আমাদের ছোটবেলার গল্পটা বলেছিলাম, ও তো শুনে খুব খুশি, তারপর থেকে আমি আর তিতলী ভূত চতুর্দশীর সন্ধ্যায় বাড়ির বাইরের সব ইলেকট্রিক আলো নিভিয়ে সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালাতাম, তিতলী ছিলো বেশ সাহসী,আমার আর দিদির মতো ভীতুরাম নয় , আমার মতো আধবুড়ো লোকের এই পাগলামী দেখে বাড়ির অন্যান্যরা (আমার স্ত্রী,ভাইয়েরা ,ভাইয়ের স্ত্রী) হয়তো একটু বিরক্তই হতো, কিন্তু এই পাগলামির মধ্য  দিয়েই আমি আমার ছেলেবেলা,আমার আর দিদির অপু-দুগ্গা জুটিকে ছুঁই যাবার চেষ্টা করতাম। ...................

আজ সেই ভূত চতুর্দশী, আজ আমি একা ,তিতলীও চলে গেছে চাঁদের দেশে,ফুলের দেশে ,............ আমি বাগানে একা বসে আছি, মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছি দুটো ছোট ছোট ছেলে মেয়ে মাটি দিয়ে  প্রদীপ বানাচ্ছে।............... একটা আধবুড়ো লোক আর একটা ছোট মেয়ে একটা থালায় ১৪ তা প্রদীপ নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে শেওড়াতলায়,বাঁশবাগানে,পুকুরঘাটে ,,..............!!! আমার আজ আর দীপাবলি নেই ,'দীপ নিবে গেছে মম নিশীথ সমীরে'


"অসতো মা সদ্‌গময়

তমসো মা জ্যোতির্গময়

মৃত্যোর্মামৃতং গময়।

আবিরাবীর্ম এধি।

রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং

তেন মাং পাহি নিত্যম্‌।"

আমাকে তমসা থেকে আলোর দিকে নিয়ে  চলো,.......

আমাকে আলোর পথ দেখাও ,.......................

আমাকে এ অন্ধকার থেকে মুক্তি দাও ,.....


 বাংলা পঞ্জিকামতে আশ্বিন মাসের চতুর্দশী তিথিকে ভূত চতুর্দশীও বলে।
কালিপুজো/দীপাবলি/দিওয়ালির একদিন আগে সাধারনত ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়।
এই দিনে চৌদ্দ শাক, চৌদ্দ পিদিম জ্বালিয়ে চৌদ্দ পুরুষের অতৃপ্ত আত্মাদের তুষ্ট করে, অশুভ শক্তিকে দূর করার রেওয়াজ আছে ।  দীপাবলির আগের দিন ভূত চতুর্দশী নামে পরিচিত। এই দিন চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালান হয় দীপাবলীর সূচনা হয়েছিল বর্ষান্তে কীটের উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য। কীটের উপদ্রবে হৈমন্তিক ফসল নষ্ট না হয়ে যায় তার জন্য এক সঙ্গে অনেক দীপ জ্বালিয়ে কীট নির্মূল করার জন্য মানুষ এটা করেছিল ।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের পর যখন বাঙলায় পূর্ব ভারতে তন্ত্রের স্রোত বইতে শুরু করল তখন তারা তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ রাত হিসেবে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যাকে বেছে নিয়েছিল। গোটা বছরের সব চেয়ে অন্ধকার হচ্ছে এই কার্ত্তিকী অমাবস্যা।
এই অন্ধকারের বিরুদ্ধে অমানিশায় যুঝবার জন্য সেকেলের মানুষ, বিশেষ করে বাঙলার মানুষ আলোক সজ্জা করেছিল। ঘন ঘোর তমসার  বিরুদ্ধে যুঝবার জন্য এই দীপাবলী।
  চৌদ্দ শাক খেয়ে দিনটি পবিত্র ভাবে পালন করে সন্ধ্যায়
মৃত পূর্বপুরুষ দের উদ্দ্যেশে সাতটি প্রদীপ
দেওয়া হয়। একে "যম প্রদীপ" বলে। বলা হয় এতে যমরাজ প্রসন্ন হয়ে মৃত ব্যাক্তির
আত্মাকে মুক্ত করেন । সমস্ত পৃথিবীর মানুষ দের মতো হিন্দুরাও বিশ্বাস করে এই দিনটি তে মৃত আত্মারা পৃথিবীতে নেমে আসেন। যাই হোক ভূত চতুর্দশীর একটি অন্য রকম অর্থ দাড়ায় । ভূত
চতুর্দশীর পর দিন দীপান্বিতা অমাবস্যা।
মহাশক্তি মা কালীর পূজার দিন । আমাদের এই দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি। আকাশ, ভূমি, জল, অনল, পবন.........।।
। দেহান্তে শ্মশানে দেহ দাহ হলে এই শরীর
পঞ্চভূতে বিলীন হয় । সুতরাং এই পঞ্চভূতের শরীর কে নশ্বর জ্ঞানে এই দিনটি পবিত্র ভাবে থেকে চৌদ্দ শাক ভক্ষণ করে, সন্ধ্যায় ধর্মরাজের নামে প্রদীপ উৎসর্গ করে পর দিবস মা কালীর উপাসনায় ব্রতী হবার শিক্ষে দেয়। তাই
এই দিন ভূত চতুর্দশী নামে খ্যাত । প্রেতাত্মার কথা বলতে এখানে দেহের নশ্বর মূর্তির কথাই তুলে ধরা হয়েছে ।
সনাতন ধর্ম বা ভারতীয় আঞ্চলিকতায়  বিভীন্ন অশরীরি আত্মার কথা পাওয়া যায় তেমনী পুরাণ গুলোতে ভূত পিশাচ বেতাল ডাকিনী ইত্যাদি রকম নাম পাওয়া যায় । সকল পূজার পূর্বে ভূতের নামে পূজা দিয়ে তাদের তারাতে হয় নাহলে পূজায় বিঘ্ন ঘটে ।
ভূত কে বিস্বাস না করার কিছু নেই কারণ, সকল আত্মাই স্বর্গ বা নরকে যেতে পারে না । বিভীন্ন কারণে তারা পৃথিবীতে থেকে যায় । কেউ বা অতৃপ্ততার জন্য কেউবা অপঘাতে মৃত্যুর জন্য । ভূত যোনীতে থাকা আত্মারা পৃথিবীতে থেকেও নরক যন্ত্রনা ভোগ করে । যখন তারা এই পৃথিবীর মানুষদের সুখে থাকতে দেখে তখন তারা তাদের সুখকে বিঘ্ন ঘটাতে চায় ।
কিন্তু মনে রাখতে হবে টিভি সিনেমার ভূত আর বাস্তব ভূত একদম আলাদা । কারণ, ভূত কারো ক্ষতি করতে পারে না, মানুষ ভূত কে অনুভব করে নিজেদের মধ্যই একটা চিত্র তৈরী করে নেয় আর তার বর্ণনা দেয় । আপনাদের অবগতির জন্য বলতে হচ্ছে, পরমাণুর ১০লক্ষ ভাগের সমান একটি আত্মা সুতরাং তার কোন দেহ বা রুপ চর্মচক্ষুতে দেখা অসম্ভব ।
আজকের এই চতুর্দশীকে পশ্চিম ভারতের লোকেরা নরক চতুর্দশী বলে, বাঙলায় ভুত চতুর্দশী। এই দিন চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালান হয়, এর অর্থ পরের দিন ভালো করে আলো জ্বালব, অন্ধকারে আলোকসম্পাত করবো। আসলে এর অন্তরনিহিত অর্থ হল - চৌদ্দটা প্রদীপ জ্বালিয়ে শর- রিপু অষ্ট - পাশ কে দূর করা, নিজের ভাব লোকে আলোক উজ্জ্বল করা।

 আমাদের ভূত চতুর্দশীর বিদেশি নাম “হ্যালোউইন”। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর সারা বিশ্বে পালিত হয় হ্যালোউইন। `হ্যালোউইন`কে পৃথিবীর কোথাও কোথাও `অল হ্যালোস ইভ`ও বলা হয়। অল সেন্টস ডে-র সন্ধেবেলা অর্থাৎ অক্টোবর মাসের শেষ দিনে বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় হ্যালোউইন। কুমড়ো দিয়ে গা ছমছম লন্ঠন জ্বালিয়ে ভূতুড়ে পোষাকে কস্টিউম পার্টিতে `হ্যালোউইন` উত্সবে মেতে ওঠে সবাই। উদ্দেশ্য অতৃপ্ত আত্মাদের বিদায় জানানো। অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতেই এই `হ্যালোউইন`। বলতে গেলে অনেকটা ভূত চতুর্দশীর মতই।
বলা হয় এদিন মৃত প্রেতাত্মারা পৃথিবীতে আসেন। এটা হিন্দুদের "হ্যালুইন উৎসব" । বিদেশে হ্যালুইন উৎসব পালন করা হয় মিষ্টিকুমড়োর ওপরের অংশ কেটে সমস্ত
বের করে মিষ্টিকুমড়োর মধ্যে চোখ মুখ
আঁকিয়ে তার মধ্যে মোমবাতি জালিয়ে রাখা হয়।
photo courtesy: azulreceptionhall.com

মানা হয় এতে প্রেতাত্মারা খুশী হন। এছাড়া এদিন ভূতের সাজসজ্জা সেজে আনন্দ উৎসব করা হয়। আমাদের  উৎসব একেবারে অন্য নিয়মে।
 অনেক অমিল । তারা চৌদ্দ শাকও খায় না।চৌদ্দ পিদিমও জ্বালায় না । আমাদেরটা তিথি মেনে হবেই মানে কালীপুজোর ঠিক আগের দিনে আর তাদেরটা ইংরেজী ক্যালেন্ডারের নির্দ্দিষ্ট দিনে মানে প্রতিবছর ৩১ শে অক্টোবর। শুধু মিল একটাই যে এবছর দুটোই কৃষ্ণপক্ষে পড়েছে।

No comments:

Post a Comment