কালী তারা মহাবিদ্যা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী ।
ভৈরবী ছিন্নমস্তা চ বিদ্যা ধূমাবতী তথা ।।
বগলা সিদ্ধিবিদ্যা চ মাতঙ্গী কমলাত্মিকা ।
এতা দশ মহাবিদ্যাঃ সিদ্ধবিদ্যা প্রকীর্ত্তিতাঃ ।।
দশমহাবিদ্যা হলেন- কালী, তারা , ষোড়শী,
ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমুন্ডা, ধূমাবতী, বগলা,
মাতঙ্গী, কমলা ।
মহাবিদ্যা কথাটি মূলত সংস্কৃত শব্দ। সংস্কৃত মহা (অর্থাৎ মহৎ) ও বিদ্যা
(অর্থাৎ প্রকাশ, রূপ, জ্ঞান বা বুদ্ধি) শব্দদুটি থেকে মহাবিদ্যা কথাটির
উৎপত্তি।এর সঙ্গে কখনও কখনও সংখ্যাবাচক দশ কথাটি যুক্ত হয়ে থাকে।দিব্য
জননীর দশটি বিশেষ রূপের সমষ্টিগত নাম দশমহাবিদ্যা ।বৃহদ্ধর্ম পুরাণ–এ
বর্ণিত কাহিনি অনুসারে, শিব ও তাঁর স্ত্রী তথা পার্বতীর পূর্বাবতার
দাক্ষায়ণী সতীর মধ্যে একটি দাম্পত্য কলহ দশমহাবিদ্যার উৎস। সতীর পিতা দক্ষ
শিব ও সতীর বিবাহে মত দেননি। তাই তিনি যখন যজ্ঞের আয়োজন করেন তখন
নববিবাহিত শিব-সতীকে আমন্ত্রণ জানান না। সতী বিনা আমন্ত্রণেই পিতৃগৃহে যেতে
চাইলে শিব বারণ করেন। ক্রুদ্ধ সতী স্বামীর অনুমতি আদায়ের জন্য তৃতীয়
নয়ন থেকে আগুন বের করতে থাকেন এবং কালী বা শ্যামায় রূপান্তরিত হন। এই
মূর্তি দেখে ভীত শিব পলায়ন করতে গেলে সতী দশ মহাবিদ্যার রূপ ধারণ করে
শিবকে দশ দিক দিয়ে ঘিরে ফেলেন। এরপর শিব তাঁকে দক্ষযজ্ঞে উপস্থিত থাকার
অনুমতি দান করেন।
দেবীত্বের এই ক্রমবিন্যাসের একদিকে যেমন রয়েছেন ভয়ংকর দেবীমূর্তি, তেমনই অন্য প্রান্তে রয়েছেন এক অপরূপ সুন্দরী দেবীপ্রতিমা।
মুণ্ডমালা তন্ত্র অনুসারে দশমহাবিদ্যা হলেন কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী,
ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনী। তবে
মহাবিদ্যার সংখ্যা নিয়ে মতান্তর রয়েছে। এমনকি একটি মতে মহাবিদ্যার সংখ্যা
২৭ বলা হয়েছে। দুর্গা, কামাখ্যা ও অন্নপূর্ণাও মহাবিদ্যা। মালিনী বিজয়
গ্রন্থের মতে, মহাবিদ্যা হলেন কালী, নীলা, মহাদুর্গা, ত্বরিতা,
ছিন্নমস্তিকা, বাগ্বাদিনী, অন্নপূর্ণা, প্রত্যঙ্গিরা, কামাখ্যাবাসিনী,
বালা, মাতঙ্গী ও শৈলবাসিনী।
শাক্তধর্মের ইতিহাসে মহাবিদ্যা ধারণার বিকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এই
ধারণা শাক্তধর্মে ভক্তিবাদের সূচনা ঘটায়; অষ্টাদশ শতাব্দীতে যা লাভ করে
চূড়ান্ত সমৃদ্ধি। উত্তর-পৌরাণিক যুগে, খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ
হিন্দু দেবমণ্ডলীতে পুরুষদেবতার প্রাধান্যের প্রতিক্রিয়ারূপে এক নতুন
ধর্মান্দোলনের সূচনা ঘটেছিল। এই নতুন ধর্মমতে পরম সত্ত্বাকে নারীরূপে
কল্পনা করা হয়। এই মতকে ভিত্তি করে একাধিক ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়। এই
গ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল দেবীভাগবত পুরাণ।
দেবীভাগবত-এর সপ্তম স্কন্দের শেষ নয়টি অধ্যায় দেবী গীতা নামে পরিচিত। এটি
শাক্তধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।
শাক্তরা বিশ্বাস করেন, \"একই সত্য দশটি ভিন্ন রূপে প্রকাশিত; দিব্য জননী
দশটি বিশ্বরূপে দৃষ্ট ও পূজিত হয়ে থাকেন।” এই দশটি রূপই হল
দশমহাবিদ্যা।মহাবিদ্যাগণ প্রকৃতিগতভাবে তান্ত্রিক। তাঁদের সাধারণ নামগুলি
হল:
•
কালী : সর্বসংহারকারিনী, কাল ও মৃত্যুর দেবী। কালীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী।
কালী বা কালিকা দেবী
 |
মা ভবতারিণী, |
কালী বা কালিকা শ্যামা বা আদ্যাশক্তি নামেও পরিচিতা। কালী মূলত শাক্তদের দ্বারা পূজিতা হন। তিনি তান্ত্রিক দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবী এবং শাক্ত বিশ্বাস অনুযায়ী
বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। বাঙালি হিন্দু সমাজে মাতৃরূপে দেবী কালীর পূজা বিশেষভাবে লক্ষিত
হয়ে থাকে।
পুরাণ ও তন্ত্রে কালীর নানান রূপভেদ দেখা যায়। তবে সাধারণত তাঁর
চতুর্ভূজা, খড়্গ-নরমুণ্ডধারী,
বরাভয়দায়িনী, মুণ্ডমালাবিভূষিতা, লোলজিহ্বা, কৃষ্ণবর্ণ, মুক্তকেশী
ও শিবের বক্ষোপরি
দণ্ডায়মান মূর্তিটিই পূজিত হয়ে থাকে।
হিন্দুশাস্ত্রমতে,
কালিকা বাংলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। বাংলায় শাক্তধর্ম অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কালীরূপে শক্তির
আরাধনাও ব্যাপক। সমগ্র বাংলায় অসংখ্য কালীমন্দির দেখতে পাওয়া যায়। এই সকল
মন্দিরে আনন্দময়ী,
করুণাময়ী, ভবতারিণী ইত্যাদি নামে কালীপ্রতিমা পূজিত হন। কালীর
বিভিন্ন রূপভেদ রয়েছে। যথা – দক্ষিণাকালী,
শ্মশানকালী,
ভদ্রকালী, রক্ষাকালী,
গুহ্যকালী, মহাকালী, চামুণ্ডা ইত্যাদি। আশ্বিন মাসের অমাবস্যায় দীপান্বিতা কালীপূজা বিশেষ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য
দিয়ে পালিত হয়। এছাড়াও মাঘ মাসে রটন্তী কালীপূজা ও জ্যৈষ্ঠ মাসে ফলহারিনী কালীপূজাও বিশেষ
জনপ্রিয়। অনেক গৃহে ও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত কালীমূর্তিতে নিত্যপূজা হয়ে থাকে।
কালীসাধনায়
যাঁরা সিদ্ধিলাভ করেছেন, তাঁরা
বাঙালি হিন্দুসমাজে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র। এঁদের মধ্যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম সর্বাগ্রগণ্য। অন্যান্য প্রসিদ্ধ
কালীসাধকগণ হলেন রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত ভট্টাচার্য,
প্রমুখ। এই সূত্রে বাংলা সাহিত্যেও কালীর উপস্থিতি অত্যন্ত উজ্জ্বল। কালী
বা শ্যামাবিষয়ক পদ বাংলায় শ্যামাসংগীত নামে পরিচিত। উপরিউক্ত হিন্দু সাধকগণ তো
বটেই, অনেক মুসলমান কবিও
উৎকৃষ্ট শ্যামাসঙ্গীত রচনা করে এই ধারাকে পরিপুষ্ট করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীতকার;
তাঁর অনেক কবিতাতেও সার্থকরূপে দেবী
কালীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা কালীমন্দিরের প্রাচুর্য ও বাঙালি সমাজে কালীপূজার জনপ্রিয়তার
কারণে ভারতের অন্যান্য প্রান্তে দেবী কালী “কালী কলকাত্তাওয়ালি” (কলকাতানিবাসিনী কালী) নামে পরিচিত। কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী
এলাকার প্রসিদ্ধ কালীমন্দিরগুলি হল দক্ষিণেশ্বর,
কালীঘাট, আদ্যাপীঠ,
ঠনঠনিয়া,
ফিরিঙ্গি কালী
প্রভৃতি। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে একাধিক
সুবিদিত প্রাচীন কালীমন্দির রয়েছে। যথা – অম্বিকা-কালনার সিদ্ধেশ্বরী, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ময়দাকালী,কালিয়াগড় বা জিরাটের সিদ্ধেশ্বরী কালী মাতা, তমলুকের বর্গভীমা, উত্তর চব্বিশ পরগনার হালিশহরে রামপ্রসাদ-পূজিতা কালী প্রভৃতি। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত রমনা কালীমন্দির অত্যন্ত প্রাচীন এক
কালীমন্দির ছিল।
ব্যুৎপত্তি
‘কালী’ শব্দটি ‘কাল’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ রূপ, যার অর্থ “কৃষ্ণ, ঘোর বর্ণ” (পাণিনি ৪।১।৪২)। মহাভারত অনুসারে, এটি দুর্গার একটি রূপ (মহাভারত, ৪।১৯৫)। আবার হরিবংশ গ্রন্থে কালী একটি দানবীর নাম (হরিবংশ, ১১৫৫২)।
‘কাল’, যার অর্থ ‘নির্ধারিত সময়’, তা প্রসঙ্গক্রমে ‘মৃত্যু’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এর সমোচ্চারিত শব্দ ‘কালো’র সঙ্গে এর কোনও
প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। কিন্তু লৌকিক
ব্যুৎপত্তির দৌলতে এরা পরস্পর সংযুক্ত হয়ে গেছে। মহাভারত-এ এক দেবীর উল্লেখ আছে যিনি হত যোদ্ধা ও পশুদের আত্মাকে বহন করেন। তাঁর নাম
কালরাত্রি বা কালী। সংস্কৃত সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক টমাস কবার্নের
মতে, এই শব্দটি নাম হিসাবে ব্যবহার করা হতে পারে আবার ‘কৃষ্ণবর্ণা’ বোঝাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
পূজানুষ্ঠান
দুর্গাপূজার মতো কালীপূজাতেও গৃহে বা মণ্ডপে মৃন্ময়ী
প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়। মন্দিরে বা গৃহে প্রতিষ্ঠিত প্রস্তরময়ী বা
ধাতুপ্রতিমাতেও কালীপূজা করা হয়। মধ্যরাত্রে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে
মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দেবীকে ছিন্নমস্তক সহ বলির পশুর রক্ত, মিষ্টান্ন, অন্ন বা লুচি, মাছ ও মাংস উৎসর্গ করা হয়। গৃহস্থবাড়িতে সাধারণত
অতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যমতে আদ্যাশক্তি কালীর রূপে কালীর পূজা হয়। দেবীর পূজায় ছাগ
মেষ বা মহিষ বলির প্রথা রয়েছে। সুদূর অতীতে নরবলি দিয়েও কালীপূজা হত।তবে বর্তমানে সময়ের সাথে সাথে ধর্মাচরণেও পরিবর্তন ঘটেছে , বিভিন্ন মন্দিরে বলি প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে, এখনো যে সব মন্দিরে বলি প্রথা চালু আছে সামাজিক সচেতনতায় সে গুলোও আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে, এ বিষয়ে আমি আশাবাদী। লোকবিশ্বাস
অনুযায়ী, কালী শ্মশানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। এই
কারণে কলকাতা সহ বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে শ্মশানে
মহাধুমধামসহ শ্মশানকালী পূজা অনুষ্ঠিত হয়।
কোনো কোনো মণ্ডপে কালী ও শিবের মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে বাংলার
দুই বিখ্যাত কালীসাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস ও বামাখ্যাপার মূর্তিও পূজিত
হয়। কোথাও কোথাও কালীর সঙ্গে সঙ্গে দশমহাবিদ্যাও পূজিত হন। দর্শনার্থীরা সারারাত ধরে মণ্ডপে মণ্ডপে
ঘুরে কালীপ্রতিমা দর্শন করেন। কালীপূজার রাতে গৃহে আলোকসজ্জা সাজানো হয় এবং
আতসবাজি পোড়ানো হয়।
কলকাতার কালীঘাট মন্দিরে এই দিন দেবী
কালীকে লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়। হাজার হাজার ভক্ত এই দিন কালীঘাট মন্দিরে ভিড়
করেন এবং দেবীর উদ্দেশ্যে বলি উৎসর্গ করেন। কলকাতার অপর বিখ্যাত কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বর
কালীবাড়িতেও কালীপূজা উপলক্ষ্যে মহাসমারোহ হয়। এইখানেই অতীতে রামকৃষ্ণ
পরমহংস কালী আরাধনা করেছিলেন। সেই কারণে এই মন্দিরে কালীপূজা দেখতে প্রচুর
পুণ্যার্থী এখানে ভিড় জমান।

•
তারা : পথপ্রদর্শক ও রক্ষাকারিনী (তারিনী) দেবী। বিশ্বের উৎস হিরণ্যগর্ভের শক্তি এবং মহাশূন্যের প্রতীক।
তারা হিন্দু দেবী কালীর একটি বিশিষ্ট রূপ। ইনি
দশমহাবিদ্যার দ্বিতীয় মহাবিদ্যা। কালীর
মতোই তারা ভীষণা দেবী। তারার
বিভিন্ন রূপান্তর উগ্রতারা,
নীল সরস্বতী, কুরুকুল্লা তারা, খদির বাহিনী তারা, মহাশ্রী তারা, বশ্যতারা, সিতাতারা, ষড়ভূজ
সিতাতারা, মহামায়া বিজয়বাহিনী তারা
ইত্যাদি। বৌদ্ধধর্মেও তারাদেবীর
পূজা প্রচলিত। তারার
মূর্তিকল্পনা কালী অপেক্ষাও প্রাচীনতর। কোনো
কোনো মতে তারা দুর্গা বা চণ্ডীর রূপান্তর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার তারাপীঠে অবস্থিত দেবী তারার মন্দির
বিখ্যাত।
মূর্তিতত্ত্ব
তন্ত্রসারে দেবী
তারার
যে
রূপ
বর্ণিত
হয়েছে
তা
নিম্নরূপ:
"তারা প্রত্যালীঢ়পদা অর্থাৎ
শববক্ষে দক্ষিণপদ স্থাপিতা। ভয়ংকরী, মুণ্ডমালাভূষিতা, খর্বা,
লম্বোদরী, ভীষণা,
কটিতে
ব্যাঘ্রচর্মাবৃতা, নবযৌবনা, পঞ্চমুদ্রা শোভিতা,
চতুর্ভূজা, লোলজিহ্বা, মহাভীমা, বরদা,
খড়্গ
কাতরি
দক্ষিণহস্তে ধৃতা,
বামহস্তদ্বয়ে কপাল
ও
নীলপদ্ম, পিঙ্গলবর্ণ একজটাধারিণী, ললাটে
অক্ষোভ্য প্রভাতসূর্যের মতো
গোলাকার তিন
নয়নশোভা, প্রজ্জ্বলিত চিতামধ্যে অবস্থিতা, ভীষণদন্তা, করালবদনা, নিজের
আবেশে
হাস্যমুখী, বিশ্বব্যাপ্ত জলের
মধ্যে
শ্বেতপদ্মের উপর
অবস্থিতা।"
তন্ত্রসারে তারার
আরও
একটি
ধ্যানমন্ত্র বর্ণিত
হয়েছে:
"শ্যামবর্ণা ত্রিনয়না দ্বিভূজা, বরমুদ্রা ও
পদ্মধারিণী, চতুর্দিকে বহুবর্ণা ও
বহুরূপা শক্তির
দ্বারা
বেষ্টিতা, হাস্যমুখী মুক্তাভূষিতা, রত্নপাদুকায় পাদদ্বয় স্থাপনকারিণী তারাকে
ধ্যান
করবে।"বৃহদ্ধর্ম পুরাণে তারাকে কেবল
শ্যামবর্ণা ও
কালরূপিণী বলে
উল্লেখ
করা
হয়েছে।তন্ত্রসারে তারাকেই মহানীল
সরস্বতী বলে
উল্লেখ
করা
হয়েছে।
ভারতচন্দ্র রায় তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে তারার যে
রূপবর্ণনা করেছেন,
তা
নিম্নরূপ:
তারা
রূপ
ধরি
সতী
হইলা
সম্মুখ।।
নীলবরণা লোলজিহ্বা করালবদনা। সর্পবান্ধা ঊর্দ্ধ
এক
জটাবিভূষণা।।
অর্দ্ধচন্দ্র পাঁচখানি শোভিত
কপাল।
ত্রিনয়ন লম্বোদর পরা
বাঘছাল।।
নীল
পদ্ম
খড়্গ
কাতি
সমুণ্ড
খর্পর।
চারি
হাতে
শোভে
আরোহণ
শিবোপর।।
তারাপীঠের ব্রহ্মশিলায় খোদিত তারামূর্তিটি দ্বিভূজা, সর্পযজ্ঞোপবীতে ভূষিতা
এবং
তাঁর
বাম
কোলে
পুত্ররূপী শিব
শায়িত।
•
ত্রিপুরসুন্দরী বা ললিতা-ত্রিপুরসুন্দরী (ষোড়শী) : পূর্ণতা ও পূর্ণাঙ্গতার স্বরূপ। শ্রীকুল সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ দেবী। তান্ত্রিক পার্বতী নামে পরিচিতা।
ত্রিপুরসুন্দরী
বা ষোড়শী বা ললিতা এক হিন্দু দেবী। ইনি দশমহাবিদ্যার অন্যতমা। ত্রিপুরসুন্দরী রাজরাজেশ্বরী নামেও পরিচিতা।
ত্রিপুরসুন্দরীর ষোড়শী রূপটি ষোড়শবর্ষীয়া
এক বালিকার রূপ। এই রূপ ষোড়শপ্রকার কামনার প্রতীক। ষোড়শীতন্ত্রে
ত্রিপুরাসুন্দরীকে "শিবের নয়নজ্যোতি" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি কৃষ্ণবর্ণা ও
শিবোপরি উপবিষ্টা। শিব ও ষোড়শীকে শয্যা,
সিংহাসন অথবা ব্রহ্মা,
বিষ্ণু,
রুদ্র ও ইন্দ্রের মস্তকোপরিস্থিত বেদিতে উপবিষ্ট রূপে কল্পনা করা হয়।
ললিতা শ্রীবিদ্যা
সংক্রান্ত অন্যতমা দেবী। ললিতা ধনুক,
পঞ্চবাণ,
পাশ ও অঙ্কুশধারিনী। পাশ-অঙ্কুশ বন্ধন ও মুক্তির প্রতীক,
পঞ্চবাণ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের প্রতীক এবং ইক্ষুধনু মনের
প্রতীক।
ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার নাম ত্রিপুরসুন্দরীর নাম থেকে ব্যুৎপত্তিলাভ করেছে। উদয়পুর
শহরের অদূরে রাধাকিশোরপুর গ্রামের নিকট একটি পাহাড়চূড়ায় অবস্থিত ত্রিপুরসুন্দরী
মন্দির দেবীর প্রধান মন্দির।
কাশ্মীরি পণ্ডিতরা ত্রিপুরাসুন্দরীর পাঁচটি স্তবগান
সংকলন করেছেন। পঞ্চস্তবী নামে পরিচিত এই স্তবগানগুলি উক্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে আজও
জনপ্রিয়।
ত্রিপুর শব্দের অর্থ ত্রিভুবন;
অর্থাৎ স্বর্গ,
মর্ত্য ও পাতাল। এই কারণে ত্রিপুরসুন্দরী
শব্দের অর্থ ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। অন্য এক মতে,
দেবীর অপর নাম ত্রিপুরা। কারণ তিনি ব্রহ্মা,
বিষ্ণু ও শিবের শক্তি ব্রহ্মাণী,
বৈষ্ণবী ও রুদ্রাণীর সম্মিলিত রূপ।
হিন্দু
ধর্মসাহিত্যে ত্রিপুরসুন্দরীকে পরমাসুন্দরী দেবীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ললিতা সহস্রনাম
ও সৌন্দর্যলহরী
স্তোত্রে তাঁর রূপবর্ণনা করা হয়েছে।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, কামনা
সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি সৃষ্টির স্রোত অবারিত রাখেন। আদি শঙ্করাচার্য তাঁর ত্রিপুরসুন্দরী
অষ্টকম স্তোত্রে
ত্রিপুরসুন্দরীকে বিশ্বজননী বলেছেন।
ত্রিপুরাসুন্দরীর মধ্যে কালীর শক্তি ও দুর্গার সৌন্দর্য ও মহত্বের সম্মিলন লক্ষিত হয়। ধর্মীয় সাহিত্যের
বর্ণনা অনুযায়ী
তিনি ত্রিনয়নী,
চতুর্ভুজা,
রক্তাম্বর পরিহিতা,
সর্বালঙ্কারভূষিতা এবং স্বর্ণসিংহাসনের
উপর পদ্মাসনে উপবিষ্টা। তাঁর হস্তধৃত বস্তুগুলি শিবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। তাঁর মূর্তিতে
রাজকীয় আভা থাকায় তাঁকে রাজরাজেশ্বরী নামে অভিহিত করা হয়।
•
ভুবনেশ্বরী : বিশ্বজননী। পার্থিব জগতের শক্তিসমূহের প্রতীক।
দেবী ভূবনেশ্বরী
দেবী ভূবনেশ্বরী শারীরিক নিসর্গ উপাদান হিসেবে দশ মহাবিদ্যা দেবীর একটি দৃষ্টিভঙ্গি যাতে চতুর্থ "বিশ্ব সৃষ্টি আকৃতি প্রদান হয়, এছাড়াও ভূবনেশ্বরীকে বিবেচনা করা হয় সবকিছু সৃষ্টি করে এবং বিশ্বের সব অপ্রয়োজনীয় খারাপ ধ্বংস করে দেয়া যার সুপ্রিমক্ষমতা ।তাকে মা কালি দেবী, লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং গায়ত্রী হিসাবে গণ্য করা হয়। হিন্দু পুরাণে তিনি মহাবিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেবী হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিশ্বের
রানী বা সমস্থ জগতের রানী হিসাবে বা শাসক হিসাবে ভূবনেশ্বরীকে দেখা হয় । মা ভুবনেশ্বরীর সমস্ত শরীরের বিশ্বকে পাওয়া
যায় এবং সব মানুষ তার অলঙ্কার হয়। তিনি নিজ প্রকৃতি তার নিজস্ব একটি ফুল সব বোথ ওয়ার্ল্ডস বহন করেন। তিনি এইভাবে সুন্দরী এবং রাজেশ্বরী, ইউনিভার্স সুপ্রিম লেডির সাথে সম্পর্কিত হন।
তিনি আদি শক্তি হিসাবে পরিচিত । তিনি তার ইচ্ছা অনুযায়ী পরিস্থিতিতে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম।
সারা ভারতে ভূনেশ্বরী দেবীর বিভিন্ন মন্দির আছে । উত্তর আমেরিকায়, দেবী ভূবনেশ্বরী পন্টিয়াক, মিশিগান পরাশক্তি মন্দিরে ভূবনেশ্বরী
দেবীর পূজা করা হয়
•
ভৈরবী : ভয়ংকরী দেবী। সেই কামনা ও প্রলোভনের স্বরূপ যা মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
ভৈরবী
মূলত ভৈরব এর স্ত্রী রুপ। এ রুপটি দেবী কালীর আরেকটি রুপ। কালীর মতই প্রায় একইরকম
হিংস্র ও আতংককর দৃষ্টিভঙ্গি
বিশিষ্ট্য একটি রুপ।
তাকে সুভংকরী বলা হয় তিনি ভালর জন্য ভাল মা এবং
খারাপের জন্য ভয়ংকর হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। তিনি বালা বা ত্রিপুরা ভৈরবী হিসাবেও
পরিচিত।
সংগীতে দেবীঃ উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে
ঠাট ও রাগ বিশেষ কে ভৈরবী নামে অভিহিত করা হয় মূলত দেবীর নামের সঙ্গে মিল রেখেই।
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে— চৌষট্টি যোগিনীর মধ্যে প্রধানা। ইনি ছিলেন দুর্গার সহচরী ও তাঁরই মত পূজনীয়া। ইনি বিভিন্ন সময়ে দেবীর সহযোগী শক্তি হিসাবে দেবীকে
সাহায্য করতেন। দক্ষযজ্ঞে দক্ষ মহাদেবের নিন্দা
করলে, সতীর আত্মহত্যা করেন। এরপর মহাদেব দক্ষযজ্ঞ ধ্বংস করেন এবং সতীরে মৃতদেহ নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য শুরু করেন।
এর ফলে পৃথিবী ধ্বংসের উপক্রম হয়। পৃথিবীকে রক্ষা করার জন্য- বিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্রের দ্বারা সতীর দেহকে ৬৪
খণ্ডে বিভাজিত করেন। সতীদেহের খণ্ডিত অংশ যে সকল পতিত হয়েছিল,
সে সকল স্থান পীঠস্থান নামে পরিচিত। এই সকল পীঠস্থানের অধিষ্ঠাত্রী দেবতারা সাধারণ ভাবে ভৈরব নামে অভিহিত হন।
ভৈরবী হলো— ভৈরবের
স্ত্রী সত্তার নাম। এই ঠাট ও রাগের নাম পৌরাণিক দৈবসত্তা ভৈরবীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে।
মন্দিরঃ অনেক দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরে বালা ত্রিপুরা দেবী হিসেবে
দেবী ভৈরবী পূজিতা হয়। তার বিখ্যাত
মন্দির হল পুরীর ভিমলায় অবস্থিত জগন্নাথ মন্দির। ভিমলা মন্দির ভৈরবী মন্দির নামে
•
ছিন্নমস্তা : উলঙ্গিনী দেবীমূর্তি। তিনি স্বহস্তে নিজ মস্তক
ছিন্ন করে নিজ রক্ত নিজেই পান করেন। চক্রপথে আত্মধ্বংস ও আত্মপুনরুজ্জীবনের
মাধ্যমে সৃষ্ট জগতের অবিরাম বিদ্যমানতার শক্তির প্রতীক।
ছিন্নমস্তা দেবী। তিনি দশমহাবিদ্যার অন্যতমা এবং মহাশক্তির
একটি ভীষণা রূপ। ছিন্নমস্তা দেবী ছিন্নমস্তিকা বা প্রচণ্ড চণ্ডিকা নামেও
পরিচিতা। তাঁর ভয়ংকর মূর্তিটি দেখে সহজেই তাঁকে চেনা যায়। তিনি এক হাতে
থাকে তাঁর নিজের ছিন্ন মুণ্ড, অপর হাতে থাকে একটি কাতরি; দেবীর কবন্ধ থেকে
তিনটি রক্তধারা নির্গত হয়ে একটি তাঁর নিজের মুখে এবং অপর দুটি তাঁর দুই
সহচরীর মুখে প্রবেশ করে। ছিন্নমস্তা সাধারণত রতিসংগমরত যুগলের দেহের উপর
দণ্ডায়মান অবস্থায় কল্পিতা হন।
উৎস
ছিন্নমস্তা আত্মবলিদান ও কুণ্ডলিনী জাগরণের দেবী। তাঁকে একাধারে যৌনসংযম ও
যৌনশক্তির প্রতীক মনে করা হয়। অন্যদিকে তিনি একাধারে দিব্যজননীর
জীবনদাত্রী ও জীবনহন্তা সত্ত্বারও প্রতীক। তাঁর আত্মবলিদানের কিংবদন্তিটির
সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর মাতৃসত্ত্বা, যৌন কর্তৃত্ব ও
আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা হলেও এককভাবেও তাঁর পূজা
প্রচলিত। উত্তর ভারত ও নেপালে ছিন্নমস্তার একাধিক মন্দির রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরের ছিন্নমস্তা মন্দিরটিও প্রসিদ্ধ। তবে
গৃহস্থবাড়িতে তাঁর পূজা করা হয় না। তার কারণ, লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি
এক ভীষণা দেবী এবং তাঁর পূজা করা বা দর্শন কামনা করা বিপজ্জনক। কেবলমাত্র
তান্ত্রিক, যোগী ও সর্বত্যাগীগণ বীরাচার মতে তাঁর পূজা করে থাকেন।
হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মে ছিন্নমস্তার পূজা প্রচলিত। তিব্বতি বৌদ্ধ দেবী
বজ্রযোগিনীর ছিন্নমুণ্ডা রূপটির সঙ্গে দেবী ছিন্নমস্তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
তিনি দেবী বজ্রযোগিনী বা বজ্রবারাহীর ছিন্নমস্তক মূর্তি।
বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রে বৌদ্ধ ছিন্নমুণ্ডার একটি জন্মবৃত্তান্ত বর্ণিত হয়েছে।
কৃষ্ণাচার্যের শিষ্যা ছিলেন দুই বোন মেখলা ও কনখলা। তাঁরা ছিলেন মহাসিদ্ধা।
তাঁরা নিজেদের মাথা কেটে গুরুকে উপহার দেন এবং তারপর নৃত্য করেন। দেবী
বজ্রযোগিনী সেই রূপেই সেখানে উপস্থিত হন এবং তাঁদের সঙ্গে নৃত্যে যোগ দেন।
অন্য একটি কাহিনি অনুসারে, পদ্মসম্ভবের এক শিষ্যা পূর্বজন্মে ছিলেন
রাজকুমারী লক্ষ্মীঙ্করা। রাজশাস্তি গ্রহণ করে তিনি নিজের মাথা কেটে নগর
পরিক্রমা করেন। নগরবাসী তাঁকে ছিন্নমুণ্ডা-বজ্রবারাহী রূপে পূজা করে।
গবেষক বি. ভট্টাচার্য বৌদ্ধ সাধনমালা (১১৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), হিন্দু
ছিন্নমস্তাকল্প ও তন্ত্রসার (সপ্তদশ শতাব্দী) প্রভৃতি গ্রন্থ আলোচনা করে
দেখিয়েছেন যে, বৌদ্ধ ছিন্নমুণ্ডা ও হিন্দু ছিন্নমস্তা একই দেবী। কেবলমাত্র
দেবী ছিন্নমস্তা নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী এবং রতি-কামদেবের উপর দণ্ডায়মানা।
বৌদ্ধ সাধনমালা গ্রন্থে তাঁর নাম সর্ববুদ্ধা এবং তাঁর সহচরীদের নাম
বজ্রবৈরোচনী ও বজ্রবর্ণনী। হিন্দু তন্ত্রসার গ্রন্থে তাঁর নাম সর্বসিদ্ধি
এবং তাঁর সহচরীগণ হলেন ডাকিনী, বৈরোচনী ও বর্ণনী। ছিন্নমস্তাকল্প গ্রন্থে
দেবীর নাম সর্ববুদ্ধি এবং তাঁর সহচরীদের নাম বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুরূপ।
ভট্টাচার্যের মতে, সপ্তম শতাব্দীতে পূজিত বৌদ্ধ ছিন্নমুণ্ডা দেবীই হিন্দু
ছিন্নমস্তার উৎস।
তবে ভট্টাচার্যের মতামত বিতর্কিত।শঙ্করনারায়ণন প্রমুখ গবেষক ছিন্নমস্তার
বৈদিক (প্রাচীন ভারতীয়) উৎস সন্ধান করেছেন। এস. ভট্টাচার্যের মতে বৈদিক
দেবী নিঋতির বৈশিষ্ট্যাবলি পরবর্তীকালে কালী, চামুণ্ডা, করালী ও
ছিন্নমস্তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়। শাক্ত মহাভাগবত পুরাণ (৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ) ও
দেবীভাগবত পুরাণ নামে উপপুরাণ দুটিই প্রথম হিন্দু গ্রন্থ যাতে ছিন্নমস্তার
উল্লেখ পাওয়া যায়। বারনার্ড বলেছেন, উৎস যাই হোক না কেন, একথা স্পষ্ট যে
খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে ছিন্নমস্তা বা ছিন্নমুণ্ডার পূজা প্রচলিত ছিল
এবং মহাসিদ্ধারা তাঁর পূজা করতেন। ভ্যান কুইজ ছিন্নমুণ্ডা ছাড়ায়
তান্ত্রিক দেবী বারাহী ও চামুণ্ডার মধ্যেও ছিন্নমস্তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য
খুঁজে পেয়েছেন।
ডেভিড কিংসলে ছিন্নমস্তার বৌদ্ধ উৎসের তত্ত্বটি মেনে নিলেও, অন্যান্য
প্রভাবের কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, মহাবিদ্যার ধারণাটি সম্ভবত খ্রিষ্টীয়
দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ববর্তী নয়।যে সকল প্রাচীন হিন্দু দেবীর মূর্তি নগ্ন ও
কবন্ধের আকারে কল্পিত হত, তাঁরা ছিন্নমস্তার বিবর্তনে কিছু ভূমিকা পালন
করেছিলেন। এই সকল দেবীর যৌন অঙ্গের প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য
এঁদের কবন্ধ আকারে কল্পনা করা হত। এই জন্য এঁদের যৌনশক্তির প্রতীক মনে করা
হয়। তবে এই তত্ত্ব স্বমস্তক ছিন্ন করার বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে না।কুচক্রী
যুদ্ধদেবী কোটাভী ও দক্ষিণ ভারতীয় মৃগয়া দেবী কোরাভাই ছিন্নমস্তার
রূপকল্পনায় অনুপ্রেরণার কাজ করে থাকবেন। কোটাভীকে কোথাও কোথাও মাতৃকা রূপে
কল্পনা করা হয়েছে। তিনি নগ্না, বিস্রস্ত বসনা এবং ভীষণা। বিষ্ণু পুরাণ ও
ভাগবত পুরাণে একাধিক স্থানে তাঁকে বিষ্ণুর শত্রু রূপে কল্পনা করা হয়েছে।
ভীষণা দেবী কোরাভাইও যুদ্ধ ও বিজয়ের দেবী। দুজনেরই সম্পর্ক রয়েছে
যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে, কিন্তু ছিন্নমস্তার তা নেই।কিংসলে বলেছেন, হিন্দু
পুরাণে একাধিক রক্তপিপাসু, নগ্ন ও ভীষণা দেবী ও দানবীর উল্লেখ থাকলেও,
ছিন্নমস্তাই একমাত্র দেবী যাঁকে ভয়াল নিজমুণ্ড-ছিন্নকারিণী রূপে কল্পনা
করা হয়।
কিংবদন্তি ও শাস্ত্রোল্লেখ
বিভিন্ন স্তোত্রে ছিন্নমস্তাকে পঞ্চম মহাবিদ্যা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিংসলে বলেছেন, মহাবিদ্যার বর্ণনায় ও তালিকায় কালী, তারা ও ছিন্নমস্তাই
সর্বপ্রধান। যদিও মহাবিদ্যার বাইরে তাঁর অস্তিত্ব নগণ্য।গুহ্যাতিগুহ্য
তন্ত্র গ্রন্থে বিষ্ণুর দশাবতারের সঙ্গে দশমহাবিদ্যার সম্পর্ক প্রদর্শিত
হয়েছে; এই গ্রন্থ মতে, নরসিংহ অবতারের উৎস ছিন্নমস্তা।[১৩] মুণ্ডমালা
গ্রন্থে অনুরূপ একটি তালিকায় ছিন্নমস্তার সঙ্গে পরশুরামের তুলনা করা
হয়েছে।
শাক্ত মহাভাগবত পুরাণ গ্রন্থে ছিন্নমস্তা সহ দশমহাবিদ্যার
উৎপত্তি-সংক্রান্ত একটি উপাখ্যান রয়েছে। দক্ষের কন্যা দাক্ষায়ণী ছিলেন
শিবের প্রথমা স্ত্রী। দক্ষ তাঁর যজ্ঞানুষ্ঠানে শিবকে নিমন্ত্রণ না জানালে,
দাক্ষায়ণী অপমানিত বোধ করেন। তিনি বিনা আমন্ত্রণেই যজ্ঞে যাওয়ার অনুমতি
চেয়ে শিবকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কিন্তু শিব রাজি হন না। তখন দাক্ষায়ণী
ভীষণা দশ মূর্তি ধারণ করে দশ দিক থেকে শিবকে ঘিরে ধরেন। এই দশ মূর্তিই
দশমহাবিদ্যা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। ছিন্নমস্তা পশ্চিমে শিবের ডানদিকে
অবস্থান করেছিলেন।আর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, সতী নন, শিবের দ্বিতীয়া
পত্নী পার্বতীকে দশমহাবিদ্যার উৎস বলা হয়েছে। পার্বতী ছিলেন সতী অথবা
প্রধানা মহাবিদ্যা কালীর অবতার। পার্বতী দশমহাবিদ্যার সাহায্যে শিবকে তাঁর
পিতৃগৃহ ছেড়ে যেতে বাধা দেন। শিব পার্বতীর সঙ্গে থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে
পড়েছিলেন। তাই তিনি পার্বতীকে ত্যাগ করতে গিয়েছিলেন। এমতাবস্থায় কালী
তাঁকে জ্ঞান প্রদান করেন এবং নিরস্ত করেন।দেবীভাগবত পুরাণ মতে, দশমহাবিদ্যা
দেবী শাকম্ভরীর যুদ্ধসঙ্গী ও রূপান্তর।
প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থে ছিন্নমস্তার জন্মসংক্রান্ত দুটি কাহিনি বিবৃত
হয়েছে। একটি কাহিনি নারদ-পঞ্চরাত্র থেকে গৃহীত বলে দাবি করা হয়েছে। এই
কাহিনি অনুযায়ী, একদা মন্দাকিনী নদীতে স্নানকালে পার্বতী কামার্ত হয়ে
পড়েন। ফলে তাঁর গাত্রবর্ণ কালো হয়ে যায়। এই সময় তাঁর দুই সহচরী ডাকিনী ও
বর্ণনী (এঁরা জয়া ও বিজয়া নামেও পরিচিত) ক্ষুধার্ত হয়ে দেবীর নিকট
খাদ্য প্রার্থনা করতে থাকেন। পার্বতী গৃহে ফিরে তাঁদের খেতে দেবেন বলে
আশ্বস্ত করেন। কিন্তু সহচরীদের ক্ষুধার্ত অবস্থা দেখে কাতর হয়ে
দয়ার্দ্রহৃদয় দেবী নিজ নখরাঘাতে স্বমস্তক ছিন্ন করে নিজ রক্ত দিয়ে
তাঁদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেন। পরে তাঁরা গৃহে ফিরে আসেন। অপর কাহিনিটি
প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থে স্বতন্ত্রতন্ত্র গ্রন্থ থেকে গৃহীত বলে দাবি
করা হয়েছে। এই কাহিনিটি শিব নিজে বর্ণনা করেছেন: একদা তিনি ও তাঁর পত্নী
চণ্ডিকা (পার্বতী) রতিসংগমে রত ছিলেন। চণ্ডিকা ছিলেন বিপরীত রতিতে। কিন্তু
শিবের বীর্যস্খলনে তিনি ক্রুদ্ধা হলেন। তখন তাঁর দেহ থেকে ডাকিনী ও বর্ণনী
নামে দুই সহচরীর জন্ম হল। কাহিনির অবশিষ্টাংশ পূর্বকথিত কাহিনিটির অনুরূপ।
যদিও এই কাহিনিতে নদীটির নাম হল পুষ্পভদ্রা এবং ছিন্নমস্তার জন্মতিথিটিকে
বলা হয়েছে বীররাত্রি। শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে এই কাহিনিটি পুনঃকথিত
হয়েছে।
একটি লোকশ্রুতি অনুযায়ী, দেবাসুর যুদ্ধে দেবগণ মহাশক্তির সাহায্য
প্রার্থনা করলে দেবী প্রচণ্ড চণ্ডিকা দেবগণের সাহায্যার্থে উপস্থিত হন। সকল
দৈত্য বধের পর ক্রোধন্মত্তা দেবী নিজ মস্তক কর্তন করে নিজ রক্ত পান করেন।
শাক্তপ্রমোদ গ্রন্থে ছিন্নমস্তা শতনাম স্তোত্রে প্রচণ্ড চণ্ডিকা দেবী
ছিন্নমস্তারই অপর নাম।অপর একটি লোকশ্রুতি অনুযায়ী, সমুদ্রমন্থনের সময়
উত্থিত অমৃত দেবাসুরের মধ্যে বণ্টিত হলে, ছিন্নমস্তা অসুরদের ভাগটি পান
করেন এবং তারপর অসুরদের অমৃত থেকে বঞ্চিত করতে স্বমস্তক ছিন্ন করেন।
ছিন্নমস্তা-সংক্রান্ত কিংবদন্তিগুলির মূল উপজীব্য বিষয় হল আত্মত্যাগ –
মায়ের আত্মত্যাগ (প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থের কাহিনিদ্বয়) বা জগতের
হিতার্থে আত্মত্যাগ (দ্বিতীয় জনশ্রুতি)। এই কিংবদন্তির অপর উপজীব্য হল যৌন
কর্তৃত্ব স্থাপন (প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থের দ্বিতীয় কাহিনি) বা
আত্মবিধ্বংসী ক্রোধ (প্রথম লোকশ্রুতি)।

মূর্তিতত্ত্ব
ছিন্নমস্তার গাত্রবর্ণ জবাফুলের ন্যায় লাল অথবা কোটিসূর্যের ন্যায়
উজ্জ্বল। তিনি সাধারণত নগ্না এবং আলুলায়িত কুন্তলা। ছিন্নমস্তা ষোড়শী এবং
পীনোন্নত পয়োধরা, তাঁর হৃদয়ের নিকট একটি নীলপদ্ম বিদ্যমান। তিনি
নাগযজ্ঞোপবীত ধারণ করে থাকেন। তাঁর গলদেশে অন্যান্য অলংকারের সঙ্গে নরকরোটি
বা ছিন্নমুণ্ডের মালা দোদুল্যমান। বাম হাতে তিনি নিজমুণ্ড ধারণ করে থাকেন।
কোনো কোনো মূর্তিতে তিনি থালা বা নরকপালের উপর নিজমুণ্ড ধারণ করেন। দেবীর
ডান হাতে একটি কাতরি থাকে, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর মস্তক ছিন্ন করেন।
ছিন্নমস্তকে মুকুট ও অন্যান্য অলংকার দেখা যায়। তাঁর কবন্ধ থেকে তিনটি
রক্তধারা ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসতেও দেখা যায়। একটি রক্তধারা তাঁর এবং অপর
দুটি তাঁর দুই যোগিনী সহচরীর মুখে প্রবেশ করে। তাঁর দুই সহচরী – বামে
ডাকিনী ও ডানে বর্ণনী – উভয়েই নগ্না, জটাজুটধারিণী বা আলুলায়িত কুন্তলা,
ত্রিনয়না, পীনোন্নত-পয়োধরা, নাগযজ্ঞোপবীতধারিণী, বাম হস্তে নরকপাল ও
দক্ষিণ হস্তে কাতরিধারিণী। ডাকিনী কৃষ্ণবর্ণা; তিনি তমোগুণের প্রতীক এবং
বর্ণনী রক্তবর্ণা, তিনি রজোগুণের প্রতীক। দক্ষিণ পদ প্রসারিত ও বামপদ ঈষৎ
বঙ্কিম অবস্থায় ছিন্নমস্তা কাম ও রতির দেহের উপর যুদ্ধভঙ্গিমায়
দণ্ডায়মানা। কাম ও রতি উভয়েই প্রেমের দেবতা। কাম যৌনকামনার প্রতীক। তাঁর
দেহের উপর বিপরীত রতি ভঙ্গিমায় যৌনসংগমরত অবস্থায় রয়েছেন কামপত্নী রতি।
কাম-রতি শায়িত রয়েছেন পদ্মের উপর এবং দেবীর পশ্চাদপটে রয়েছে শ্মশানঘাট।
ছিন্নমস্তার এই জনপ্রিয় রূপটিই তন্ত্রসার ও ত্রিশক্তিতন্ত্র গ্রন্থে
বর্ণিত হয়েছে।
অনেক সময় দেবীর সহচরীগণ হাতে ছিন্নমুণ্ড (তাঁদের নিজেদের নয়) ধারণ করে
থাকেন।কোথাও কোথাও কাম-রতির বদলে কৃষ্ণ ও রাধাকে দেবীর পদতলে দেখা যায়।
কোনো কোনো মূর্তিতে যুগলের তলায় পদ্মের বদলে চিতাসজ্জা লক্ষিত হয়। কোথাও
কোথাও যুগলকে ছাড়াই ছিন্নমস্তা মূর্তি কল্পিত হয়। কোনো মূর্তিতে আবার
দেবীর তলায় তাঁর স্বামী শিবকে দেখা যায়; এই মূর্তিতে দেবী হাঁটু মুড়ে
বসে শিবের সঙ্গে রতিসংগমরত অবস্থায় থাকেন।
ছিন্নমস্তার জনপ্রিয় মূর্তিকল্পটি পীতবর্ণা ছিন্নমস্তক বৌদ্ধ দেবী
বজ্রযোগিনীর সমতুল্য। কেবল বজ্রযোগিনী মূর্তিকে যুগলকে দেখা যায় না এবং
ছিন্নমস্তা রক্তবর্ণা।
ছিন্নমস্তা তন্ত্র গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, দেবী কামদেবের উপর উপবিষ্টা,
দণ্ডায়মানা নন। সেই সঙ্গে দেবী ত্রিনয়না এবং কপালে সর্পবেষ্টিত
রত্নশোভিতা। তাঁর স্তনযুগল পদ্মবিভূষিত। তন্ত্রসার গ্রন্থের একটি বর্ণনা
অনুযায়ী, দেবী নিরাকারা ও নিজ নাভিদেশে উপবিষ্টা। কথিত আছে, এই মূর্তিটি
কেবল ধ্যানচক্ষেই দেখা সম্ভব।
কোনো কোনো বর্ণনায় ছিন্নমস্তা চতুর্ভূজা। এক্ষেত্রে দেবীর পদতলে যুগলকে
দেখা যায় না। তিনি তৃণক্ষেত্রের উপর উপবিষ্টা। তাঁর দক্ষিণ হস্তদ্বয়ের
উপরের হস্তে রক্তমাখা তরবারি ও নিচের হস্তে ব্রহ্মার ন্যায় একটি
শ্মশ্রুমণ্ডিত ছিন্নমুণ্ড; বাম হস্তদ্বয়ের উপরের হস্তে নিজ ছিন্ন মুণ্ড
এবং নিচের হস্তে রক্তময় নরকপাল। দুই নরকঙ্কাল তাঁর দুই সহচরী। তাঁরা
রক্তপানরতা। দুটি শৃগাল দেবী ও ব্রহ্মার মুণ্ডের রক্তপান রত।
গবেষক ভ্যান কুইজের মতে, ছিন্নমস্তার মূর্তিকল্পে বীর ও ভয়ানক রসের
প্রতিফলন ঘটেছে। যুগলমূর্তিটি শৃঙ্গার রসের প্রতিফলন। মূর্তির প্রধান বিষয়
হল নিজ ছিন্নমুণ্ডের রক্ত উৎসর্গ ও পান এবং যুগল মর্দন।
প্রতীকতত্ত্ব ও তৎসম্পর্কিত বিষয়সমূহ
ছিন্নমস্তা রূপের অর্থ জীবন, মৃত্যু ও যৌনতা পরস্পর স্বাধীন। ছিন্নমস্তার
মূর্তি একটি চিরন্তন সত্যের বাহক: \"জীবনকে বহন করে মৃত্যু, জীবন মৃত্যুর
দ্বারা পুষ্ট হয়, এবং জীবনই মৃত্যুকে যাথার্থতা দান করে। এবং যৌনতার
সর্বশেষ লক্ষ্য হল আরও জীবন সৃষ্টি করা। এই সব নতুন জীবনও তারপর নব নব
জীবনকে বহন করার স্বার্থে জরাগ্রস্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুতে বিলীন
হয়।\" পদ্ম ও যৌনসংগমরত যুগল জীবন ও জীবনসৃষ্টির আকুলতার প্রতীক। এরা
ছিন্নমস্তক দেবীকে জীবনীশক্তি প্রদান করে। দেবীর কবন্ধ থেকে রক্তের নির্গমন
মৃত্যু ও জীবনীশক্তি ক্ষয়ের প্রতীক। এই ক্ষয়িত শক্তি তাঁর সহচরী
যোগিনীদের মুখে প্রবেশ করে তাঁদের পুষ্ট করে। গবেষক পি. পাল ছিন্নমস্তাকে
ত্যাগ ও সৃষ্টির পুনর্নবীকরণ ধারণার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। ছিন্নমস্তা নিজেকে
ও নিজের রক্তকে উৎসর্গ করেছেন। সেই রক্ত তাঁর সহচরীগণ পান করে
বিশ্বচরাচরকে পুষ্ট করেছেন। একটি স্তবে তাঁকে ত্যাগ, ত্যাগী ও ত্যাগ
গ্রহণকারী বলা হয়েছে। কারণ তাঁর ছিন্নমস্তক একটি বলি।
কালীর ন্যায় অন্যান্য ভীষণা হিন্দু দেবীগণ দৈত্যদের মুণ্ড কর্তন করে
থাকেন। তাঁরা নিজ মস্তক ছিন্ন করার প্রথার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু ছিন্নমস্তার
মূর্তিতে দেখা যায় এক বিপরীত মস্তক উৎসর্গের প্রথা। তিনি তাঁর নিজের
মস্তক ভক্তদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তির জন্য উৎসর্গ করেছেন। এই ভাবে তিনি দেবী রূপে
জীবনদাত্রী। আবার কখনও কখনও যুগল মর্দন করে তিনি কালীর মতো জীবনহন্তা দেবী
হয়ে ওঠেন।
ছিন্নমস্তা যৌনসংগমরত কামদেব ও রতিদেবীর উপর দণ্ডায়মানা। এর দুটি ব্যাখ্যা
দেওয়া হয়। এক পক্ষের মতে, এটি যৌনকামনার আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক। অপর
পক্ষের মতে, এর অর্থ দেবী যৌনশক্তির মূর্তিস্বরূপ। তাঁর যোগিনী ও মদনাতুরা
(\"যিনি কামকে নিয়ন্ত্রণ করেন\") নামদুটি তাঁর যৌনশক্তি নিয়ন্ত্রণ ও
দমনকারিণী যোগশক্তির পরিচায়ক। কোনো কোনো চিত্রকল্পে ছিন্নমস্তা কাম-রতির
উপর উপবিষ্ট। এই চিত্রে দেবীর দমনকারিণী মূর্তি দেখা যায় না। এখানে
কাম-রতি দেবীকে যৌনক্ষমতা প্রদান করেন। কোনো কোনো মূর্তিতে দেবীকে শিবের
সঙ্গে সংগমরতা অবস্থাতেও দেখা যায়। ছিন্নমস্তার কামেশ্বরী ও
রতিরাগবিবৃদ্ধিনী নামদুটি এবং তাঁর মন্ত্রে ক্লীঁ বীজের উল্লেখ (যা কামদেব ও
কৃষ্ণের মন্ত্রেও উপস্থিত) এই তত্ত্বকে সমর্থন করে।
ছিন্নমস্তা তত্ত্ব গ্রন্থের লেখক আচার্য আনন্দ ঝা-র মতে, ছিন্নমস্তা যেহেতু
যৌনকামনার উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ, অপরের স্বার্থে বীরোচিত আত্মবলিদান ও
মৃত্যুভয়হীনতার প্রতীক, সেহেতু সৈনিকদের ছিন্নমস্তা পূজা করা উচিত। নগ্নতা
ও মস্তকহীনতা দেবীর সত্যরূপ ও \"আত্মসচেতনতাহীনতা\"-র প্রতীক। যুদ্ধে
একাধিক দৈত্যবধ করার জন্য তিনি রণজৈত্রী নামে পরিচিত। এই নাম যুদ্ধক্ষেত্রে
তাঁর প্রবল শক্তিমত্তারও পরিচায়ক।
ছিন্নমস্তা কুণ্ডলিনী শক্তি জাগরণেরও প্রতীক। যৌনসংগমরত যুগল মেরুদণ্ডের
শেষ অস্থির উপর অবস্থিত মূলাধার চক্রের প্রতীক। কুণ্ডলিনী দেহের কেন্দ্রে
সুষুম্না নদীপথে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মতালুতে অবস্থিত সহস্রারে আঘাত করে। এই
তত্ত্ব অনুযায়ী, সুষুম্না দেবীর সহস্রারে এত জোরে আঘাত করে যে, দেবীর
মস্তক ছিন্ন হয়ে যায়। ঊর্ধ্বমুখে রক্তস্রোত চক্রের গ্রন্থি ছিন্ন করার
প্রতীক। এই গ্রন্থি মানুষকে দুঃখিত, অজ্ঞ ও দুর্বল করে। ছিন্নমস্তক তুরীয়
চৈতন্যের প্রতীক। কুণ্ডলিনী যখন সহস্রারে অবস্থানকারী শিবের সঙ্গে মিলিত
হয়, তখন তিনটি রক্তধারা অমৃতের ধারায় পরিণত হয়। অন্যমতে, ডাকিনী, যোগিনী
ও ছিন্নমস্তা হলেন ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না নামে তিনটি সূক্ষ্ম নদীর
মুক্তধারার প্রতীক। সুষুম্না মূলধার ও সহস্রারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি
মেরুদণ্ডের সমান্তরালে প্রবাহিত। ইড়া দক্ষিণ অণ্ড থেকে বাম নাসারন্ধ্র
পর্যন্ত প্রবাহিত। শীতল চান্দ্র শক্তি ও মস্তিস্কের দক্ষিণ ভাগের সঙ্গে এটি
সংযুক্ত। পিঙ্গল বাম অণ্ড থেকে দক্ষিণ নাসারন্ধ্র পর্যন্ত প্রবাহিত। তপ্ত
সৌর শক্তি ও মস্তিস্কের বাম ভাগের সঙ্গে এটি সংযুক্ত।
নিজের মস্তক ছিন্ন করা মিথ্যা ভাব, অজ্ঞতা ও আমিত্ব অপসারণের প্রতীক। মস্তক
ছিন্ন করেও জীবিত থাকা অলৌকিক শক্তি ও কুণ্ডলিনী জাগরণের প্রতীক। দেবী ও
দুই যোগিনীর ত্রয়ীমূর্তি বস্তুর তিন অবস্থার দার্শনিক প্রতীক, যার সঙ্গে
সৃষ্টিশক্তিরও সম্পর্ক বিদ্যমান।
পূজা
ছিন্নমস্তা হিন্দুসমাজে এক সুপরিচিত দেবী। বিভিন্ন দেবী মন্দিরের
দশমহাবিদ্যার সঙ্গে তাঁর পূজা প্রচলিত। তবে একক দেবী হিসেবে তিনি খুব একটা
জনপ্রিয় নন। তাঁর নিজস্ব মন্দিরের সংখ্যা হাতে গোনা। এককভাবে তাঁর
সার্বজনীন পূজা সুপ্রচলিত নয়। তান্ত্রিক, যোগী ও সর্বত্যাগীগণ বীরাচারী
তান্ত্রিক মতে তাঁর পূজা করে থাকেন। কিংসলের মতে দেবী ভীষণা এবং তাঁর পূজা
করা বা তাঁর নিকটে যাওয়া বিপজ্জনক – এই রকম বিশ্বাস থাকায় তাঁর পূজা
জনপ্রিয়তা পায়নি। ছিন্নমস্তার শতনাম ও সহস্রনাম স্তোত্রে দেবীর ভীষণা
প্রকৃতি ও ক্রোধের উল্লেখ আছে। এই সকল নামে তাঁকে প্রেতসেবিতা ও
রক্তপানকারিণী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি নররক্ত ও নরমাংসে প্রীতা হন।
দেহরোম, মাংস ও ভয়ংকর মন্ত্রে তাঁর পূজা করা হয়।
তন্ত্রসাধকগণ সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা লাভের জন্য ছিন্নমস্তার পূজা
করেন।ছিন্নমস্তার মন্ত্র নারী বশীকরণের জন্য ব্যবহৃত হয়।তাঁর মন্ত্র কাউকে
মন্ত্রচালিত করা বা কারোর ক্ষতি করার জন্যও ব্যবহার করা হয়। কাব্যশক্তি,
সুস্থতা, শত্রুবিজয়, বিঘ্নোপসারণ, রাজপ্রসাদ লাভ, অন্যকে আকর্ষণ,
শত্রুরাজ্য জয় ও মোক্ষলাভ – মহাবিদ্যা আরাধনার এই সকল উদ্দেশ্যেও
ছিন্নমস্তার পূজা করা হয়।
তন্ত্রসার, শাক্ত প্রমোদ ও মন্ত্র মহোদধিহ (১৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দ) নামক
তন্ত্রগ্রন্থে ছিন্নমস্তা ও অন্যান্য মহাবিদ্যার পূজাপদ্ধতি, যন্ত্র এবং
ধ্যানমন্ত্র সহ অন্যান্য মন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। তন্ত্রমতে, সাধককে নিজ
নাভিতে যোনি চক্রের প্রতীক রক্তসূর্যচক্র কল্পনা করতে বলা হয়েছে। মনে করা
হয়, এই চক্রের মধ্যেই ছিন্নমস্তার জনপ্রিয় রূপটির অবস্থান।তন্তসার
গৃহস্থকে কেবল নিরাকার রূপেই ছিন্নমস্তার পূজা করতে বলেছেন। এই গ্রন্থে আরও
বলা হয়েছে যে, যদি কোনো নারী মন্ত্রে ছিন্নমস্তাকে আবাহন জানান, তবে তিনি
ডাকিনীতে পরিণত হন, স্বামী-পুত্র হারান এবং শেষে পরিপূর্ণ যোগিনী
হন।শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে কেবল বামমার্গে দেবীর পূজা করতে বলা হয়েছে।
মন্ত্র মহোদধিহ গ্রন্থমতে, স্ত্রী ভিন্ন অপর নারীর সঙ্গে যৌনসংগম
ছিন্নমস্তা পূজার অঙ্গ। শাক্ত প্রমোদ গ্রন্থেও পূর্বোক্ত মত সমর্থন করে
যজ্ঞ ও রাত্রিকালে মদ্য ও মাংস যোগে দেবীর পূজার কথা বলা হয়েছে। কোনো কোনো
স্তবে বলা হয়েছে, দেবী রক্তে সন্তুষ্ট হন। তাই তাঁর পূজায় রক্ত বলিদান
করা হয়।শক্তিসংগম তন্ত্র মতে একমাত্র বীরেরাই বামমার্গে দেবীর পূজার
অধিকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শাক্ত প্রমোদ গ্রন্থে বলা হয়েছে, সঠিক
ভাবে দেবীর পূজা না করলে দেবী পূজকের মস্তক ছিন্ন করে রক্ত পান করেন। এই
গ্রন্থে গৃহস্থ ও ত্যাগীর জন্য পৃথক পন্থায় ছিন্নমস্তার পূজার বর্ণনা
রয়েছে।
হিমাচল প্রদেশের চিন্তাপূর্ণী ছিন্নমস্তা মন্দির একটি শক্তিপীঠ। কথিত আছে,
এই মন্দিরে সতীর কপাল পড়েছিল। দেবী এখানে ছিন্নমস্তিকা এবং কপাল উভয়
রূপেই পূজিতা হন। বারাণসীর নিকটবর্তী রামনগরের ছিন্নমস্তা মন্দিরে
তান্ত্রিকরা শবদেহ নিয়ে দেবীর পূজা করেন। ঝাড়খণ্ডের দেওঘরের (বৈদ্যনাথ)
নিকটবর্তী নন্দন পর্বত এবং রাঁচিতে অন্যান্য মহাবিদ্যার সঙ্গে ছিন্নমস্তারও
বেদী রয়েছে। অসমের কামাখ্যা মন্দির চত্বরেও অন্যান্য মহাবিদ্যার সঙ্গে
ছিন্নমস্তার বেদী বিদ্যমান। পশ্চিমবঙ্গের বিষ্ণুপুর শহরে একটি বিখ্যাত
ছিন্নমস্তা মন্দির রয়েছে। নেপালের কাঠমাণ্ডু উপত্যকা চাঙ্গু নারায়ণ
মন্দিরের কাছে একটি ছিন্নমস্তা মন্দির রয়েছে। বারনার্ডের মতে, এই সকল
মন্দিরগুলির মধ্যে প্রাচীনতমটি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত।

•
ধূমাবতী : বিধবা দেবীমূর্তি। অগ্নির দ্বারা জগৎ ধ্বংসের পর
ভষ্মরাশির মধ্য থেকে যে ধূম নির্গত হয়, তার স্বরূপ। তিনি কখনও কখনও
অলক্ষ্মী বা জ্যেষ্ঠাদেবী নামেও অভিহিতা হন।
ধূমাবতী দশমহাবিদ্যার অন্যতমা এক তান্ত্রিক দেবী।ধূমাবতী হলেন সপ্তম
মহাবিদ্যা। গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্র গ্রন্থে দশ মহাবিদ্যাকে বিষ্ণুর দশ
অবতারের উৎস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গ্রন্থ মতে মৎস্য অবতারের উৎস হলেন
ধূমাবতী। মুণ্ডমালা গ্রন্থেও একটি অনুরূপ তালিকা রয়েছে; তবে উক্ত গ্রন্থ
মতে বামন অবতারের উৎস হলেন ধূমাবতী। তিনি মহাশক্তির একটি ভীষণা রূপ।
ধূমাবতী বৃদ্ধা, কুৎসিত বিধবার বেশে সজ্জিতা, এবং কাক ও চতুর্মাস ইত্যাদি
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী অমঙ্গলজনক বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিতা। ধূমাবতীর
প্রচলিত মূর্তিকল্পে তাঁকে অশ্ববিহীন রথ বা কাকপৃষ্ঠে আরূঢ়া অবস্থায় এবং
সাধারণত শ্মশানচারিণীরূপে কল্পনা করা হয়।
বেদ বিশারদ গণপতি মুনি নিম্নলিখিত ভাষায় দেবীর বর্ণনা দিয়েছেন:
“ তিনি শূন্যরূপে প্রকীর্তিতা এবং চৈতন্যের বিলীন রূপ। সকল সত্ত্বা ব্রহ্মে
লীন হলে সমগ্র জগত চরাচরকে গ্রাস করেন তিনি। তখন দার্শনিক-কবিরা তাঁকে
মহাগরিমাসম্পন্না জ্যেষ্ঠা ধূমাবতী নামে অভিহিত করেন। তাঁর নিবাস নিদ্রা,
স্মৃতিভ্রষ্টতা, মায়া ও মায়ায় আবদ্ধ জীবের মধ্যে। কিন্তু যোগীগণের মধ্যে
তিনি সকল চিন্তা ধ্বংসকারিণী শক্তি এবং স্বয়ং সমাধি স্বরূপিণী। ”
—গণপতি মুনি, উমা সহস্রম্ ৩৮ , পৃ. ১৩—১৪,
ধূমাবতী প্রলয়ের প্রতীক। তিনিই সৃষ্টির পূর্বে ও প্রলয়ের পরে বিদ্যমান
"মহাশূন্যের" মূর্তিস্বরূপ। ধূমাবতী সাধারণত অমঙ্গলকর বিষয়গুলির সঙ্গে
সম্পর্কযুক্ত। যদিও তাঁর সহস্রনাম স্তোত্রে তাঁর কয়েকটি সদগুণেরও বর্ণনা
করেছে। তিনি কোমলস্বভাবা ও বরদাত্রী। ধূমাবতী মহাগুরু; তিনি কল্যাণ ও
অকল্যাণের বহু ঊর্ধ্বে স্থিত জগত চরাচর সম্পর্কে সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রদান
করেন। তাঁর কুৎসিত রূপটি প্রকৃতপক্ষে একটি রূপক; এই রূপ সাধককে বাইরের নকল
সৌন্দর্যের পরিবর্তে জীবনের অন্তর্নিহিত সত্যটি অনুসন্ধান করতে ও জানতে
শেখায়।
হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, ধূমাবতী সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রদান করেন;
তিনি সকল বিপদ থেকে ভক্তকে উদ্ধার করেন এবং জ্ঞান ও মোক্ষফল সহ সকল অভীষ্ট
বস্তু প্রদান করেন। শত্রুনাশের উদ্দেশ্যে তাঁর পূজা করা হয়। ধূমাবতীর পূজা
আইবড়, বিধবা বা সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের পক্ষেই প্রশস্ত বলে মনে করা হয়।
বারাণসীতে অবস্থিত ধূমাবতী মন্দিরে দেবী অমঙ্গলসূচক বিষয়গুলির ঊর্ধ্বে
স্থানীয় রক্ষাকর্ত্রীর মর্যাদা লাভ করেছেন। এখানে বিবাহিত যুগলেও তাঁর
পূজা দিয়ে থাকেন। যদিও ধূমাবতীর মন্দিরের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম, তা
সত্ত্বেও শ্মশান বা বনাঞ্চলে তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাঁর নিয়মিত পূজা হয়ে
থাকে।
দশমহাবিদ্যার বাইরে ধূমাবতীর বিশেষ কোনো অস্তিত্ব নেই। মহাবিদ্যায়
অন্তর্ভূক্তির পূর্বে তাঁর কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখও পাওয়া যায়
না।দারিদ্র্য, বিষন্নতা ও দুঃখকষ্টের দেবী রূপে ধূমাবতীর সঙ্গে মারী ও
দুঃখের দেবী নির্ঋতি এবং মন্দভাগ্য ও দারিদ্র্যের দেবী অলক্ষ্মীর মিল
পাওয়া যায়।কিনসলে দেবী জ্যেষ্ঠার সঙ্গেও ধূমাবতীর মিল খুঁজে পেয়েছেন।
বৈদিক দেবী নির্ঋতি মৃত্যু, জরা বা ক্ষয়, মন্দভাগ্য, ক্রোধ ও চাহিদার
দেবী। তাঁকে দূরে রাখার জন্য তাঁর স্তুতি করা হত। নির্ঋতির মতো ধূমাবতীও
অমঙ্গলসূচক বিষয় ও কঠোরতার দেবী। প্রাচীন হিন্দু দেবী জ্যেষ্ঠার
মূর্তিকল্পটিও ধূমাবতীর অনুরূপ। ধূমাবতীর মতো তিনিও কৃষ্ণবর্ণা, কুৎসিত ও
কাকবাহিনী। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, জ্যেষ্ঠা মঙ্গলসূচক কিছুই সহ্য করতে পারেন
না। ধূমাবতীর মতো তিনিও ঝগড়া, কুস্থানে বাস করেন এবং কোপনস্বভাবা
দেবী।সারদাতিলক তন্ত্র গ্রন্থের টীকাকার লক্ষ্মণ দেসিকা ধূমাবতীকে
জ্যেষ্ঠার অপর রূপ বলে উল্লেখ করেছেন। দেবী অলক্ষ্মী ঐশ্বর্য, সৌভাগ্য ও
সৌন্দর্যের দেবী লক্ষ্মী বা শ্রীর ভগিনী ও বিপরীত শক্তি। অলক্ষ্মী ও
ধূমাবতী দুজনেই সম্মার্জনী বা ঝাঁটা ধরে থাকেন এবং তাঁদের পতাকায় কাকের
ছবি থাকে। দুজনেই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চাহিদা ও দারিদ্র্যের দেবী।
ধূমাবতীর সঙ্গে অপর তিন দেবীর কিছু মিল থাকলেও, কিছু অমিলও আছে। যেমন,
তাঁরা কেউই ধূমাবতীর মতো বিধবার বেশে কল্পিত হন না বা তাঁদের কুৎসিত
রূপকল্পের কোনো শাস্ত্রব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। আবার উক্ত তিন দেবীর নামও
ধূমাবতীর নামস্তোত্রে অমিল। এছাড়া তাঁদের মধ্যে ধূমাবতীর যোদ্ধৃবেশ বা
মহাবিদ্যারূপে তাঁর সদগুণগুলিও দেখা যায় না। ডেভিড কিনসলে মনে করেন, উক্ত
তিন দেবী ধূমাবতীর পূর্বসূরি হলেও, তাঁরা ধূমাবতীর ঠিক "সমরূপীয়" নন।
উল্লেখ্য, কিনসলের মতে, মহাবিদ্যার ধারণাটি দ্বাদশ শতাব্দীর আগে প্রচলিত
ছিল না।
শক্তিসংগম তন্ত্র গ্রন্থে উল্লিখিত কাহিনি অনুযায়ী, সতী দক্ষের যজ্ঞকুণ্ডে
আত্মবলিদানের উদ্দেশ্যে ঝাঁপ দিলে সতীর দগ্ধ দেহের কালো ধোঁয়া থেকে
ধূমাবতী উত্থিতা হন। তিনি হলেন "সতীর দেহাবশেষ" এবং তাঁর অপমানিতা
অবতার।প্রাণতোষিণী তন্ত্র গ্রন্থে ধূমাবতীর বিধবা বেশের ব্যাখ্যা পাওয়া
যায়। একদা সতী শিবের কাছে অন্ন প্রার্থনা করেন। শিব তাঁকে অন্ন দিতে
অস্বীকার করলে, সতী তাঁর প্রচণ্ড ক্ষুধার নিবৃত্তির জন্য শিবকেই ভক্ষণ
করেন। শিব যখন তাঁকে নিষ্কৃতি দিতে অনুরোধ করেন, তখন সতী শিবকে পুনরায়
উগরে দেন। এরপর শিব তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বিধবার বেশ ধারণ করার
অভিশাপ দেন।আর একটি লোকপ্রচলিত জনশ্রুতি অনুযায়ী, দুর্গা শুম্ভ ও নিশুম্ভ
অসুরদ্বয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ধূমাবতীকে সৃষ্টি করেন। ধূমাবতী
প্রাণঘাতী ধূমের সাহায্যে দৈত্যনাশ করেন।
শাক্ত মহাভাগবত পুরাণে দশমহাবিদ্যার উৎপত্তির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই
কাহিনি অনুযায়ী, দক্ষের যজ্ঞে নিমন্ত্রিত না হয়ে দক্ষকন্যা তথা শিবের
প্রথমা স্ত্রী সতী অপমানিতা হন। তিনি বিনা আমন্ত্রণেই যজ্ঞে উপস্থিত থাকতে
চাইলে, শিব বারণ করেন। সতী অনুনয়বিনয় করে শিবকে রাজি করানোর চেষ্টা করেন,
কিন্তু সফল হন না। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে সতী দশমহাবিদ্যার রূপ ধারণ করে দশ দিক
দিয়ে ঘিরে ধরেন। এই সময় ধূমাবতী দক্ষিণপূর্ব দিকে দণ্ডায়মান ছিলেন।অপর
একটি কিংবদন্তিতেও অনুরূপ কাহিনি পাওয়া যায়; তবে এই মতে সতীর স্থলে
প্রধান মহাবিদ্যা ও অপরাপর মহাবিদ্যাগণের উৎস কালীকে স্থাপন করা
হয়েছে।দেবীভাগবত পুরাণ অনুযায়ী, দশমহাবিদ্যা হলেন শাকম্ভরীর রূপভেদ ও
সহযোদ্ধা।
প্রাণতোষিণী তন্ত্র ধূমাবতীর ধ্বংসাত্মিকা শক্তি ও প্রচণ্ড ক্ষুধার উপর
অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। উল্লেখ্য, বিশ্ববিধাতা শিবই তাঁর ক্ষুন্নিবৃত্তি
করতে সক্ষম। এটি ধূমাবতীর বিধবাবেশী অমঙ্গলসূচক রূপ এবং তাঁর
স্বামীভক্ষণকারী সত্ত্বার প্রতীক।
ধূমাবতী তন্ত্র গ্রন্থে তাঁকে বৃদ্ধা ও কুৎসিত বিধবার রূপে বর্ণনা করা
হয়েছে। তিনি শীর্ণকায়া, দীর্ঘাকার, রোগগ্রস্থা ও পাণ্ডুরবর্ণা। তিনি
অশান্ত ও কুটিল হৃদয়। তাঁর দেহে অলংকারাদি নেই। তিনি পুরনো মলিন বস্ত্র
পরিধান করে থাকেন। তিনি মুক্তকেশী। তাঁর চক্ষুদুটি ভয়ংকর, নাসিকা দীর্ঘ ও
বক্র, তাঁর তীক্ষ্ণ দাঁতের কয়েকটি পড়ে গেছে, হাসলে তাঁকে ফোকলা মনে হয়।
তাঁর কর্ণদ্বয় কুৎসিত ও অসম আকারবিশিষ্ট। তাঁর স্তন লম্বমান এবং তিনি এক
হাতে একটি কুলো ধরে থাকেন এবং অপর হাতে বরমুদ্রা বা চিন্মুদ্রা দেখান। তিনি
অশ্ববিহীন রথে আরূঢ়া এবং তাঁর পতাকায় কাকের ছবি থাকে। ধূমাবতী চতুরা।
তিনি সর্বদা ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় থাকেন। তিনি কলহের কারণ ও ভয়
প্রদানকারিনী।
প্রপঞ্চসারাসার সমগ্র অনুযায়ী, ধূমাবতী কৃষ্ণবর্ণা ও নাগ অলংকারে ভূষিতা।
তাঁর বস্ত্র শ্মশানক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত ছিন্ন বস্ত্রখণ্ডে নির্মিত। তিনি
দ্বিভূজা, শূল ও নরকপালধারিনী।কোনো কোনো মূর্তিকল্পে শূলের জায়গায় তরবারি
থাকে। একই গ্রন্থের অপর একটি বর্ণনা অনুযায়ী, ধূমাবতী বৃদ্ধা, তাঁর চর্ম
কুঞ্চিত, তিনি ক্রুদ্ধমুখ এবং মেঘশ্যামবর্ণা। তাঁর নাসিকা, চক্ষু ও কণ্ঠ
কাকের ন্যায়। তিনি ঝাঁটা, কুলো, মশাল ও গদা ধারণ করে থাকেন। তিনি নিষ্ঠুরা
ও তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত। ধূমাবতী এলোকেশী ও তিনি ভিক্ষুকের বস্ত্রপরিহিতা।
তাঁর স্তনযুগল শুষ্ক।তাঁর চুল পাকা, দাঁত ভাঙা ভাঙা ও বস্ত্র জীর্ণ ও
ছিন্ন।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে মোলারাম কর্তৃক অঙ্কিত কৃষ্ণবর্ণা ধূমাবতী। দেবী
এখানে কুলো হাতে রথারূঢ়া; দুটি কালো কাল তাঁর রথ টানছেন; ধূমাবতী এই
চিত্রে সালংকারা, যা প্রচলিত রূপকল্পের ব্যতিক্রম
কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধূমাবতী কাকবাহিনী ও ত্রিশূলধারিনী রূপে কল্পিত হন।
তিনি মুণ্ডমালাধারিণী, তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তবর্ণা, এবং তাঁর মাথার চুলা
আলুলায়িত।কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি মৃত্যুর দেবতা যমের মহিষশৃঙ্গ ধারণ করে।
এটি মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের প্রতীক।
ধূমাবতী ভয়ংকরী, তাঁর বেশ যোদ্ধার বেশ। শাক্তপ্রমোদ অনুযায়ী, তিনি ভয়ংকর
শব্দ করে হাড় চিবিয়ে খান। তাছাড়াও তিনি রণভেরী বাজিয়ে ভয়ংকর শব্দ
করেন। তিনি নরকপালের মালা পরে থাকেন, চণ্ড ও মুণ্ডের হাড় চিবিয়ে ভক্ষণ
করেন এবং রক্তের সঙ্গে মদ মিশিয়ে খান।
অবশ্য ধূমাবতীর রূপকল্পের কয়েকটি ব্যতিক্রমও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ,
অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোলারাম অঙ্কিত একটি চিত্রে দেবীকে দুটি শিকারী পক্ষীর
দ্বারা বাহিত রথে আরূঢ়া মূর্তিতে দেখা যায়। এই মূর্তিতে তাঁর এক হাতে
কুলো ও অপর হাতে বরদা মুদ্রা থাকলেও, তিনি যৌবনবতী, সুডৌলস্তনযুক্তা এবং
স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা।; যা তাঁর প্রচলিত মূর্তিকল্পের একেবারের বিপরীতধর্মী।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে বারাণসীতে অঙ্কিত একটি চিত্রে দেবী ধূমাবতী
কাকবাহনা, চতুর্ভূজা, ত্রিশূল, তরবারি, কুলো ও পাত্রহস্তা, কৃষ্ণবর্ণা,
লম্বিতস্তনযুক্তা, শ্বেতবস্ত্রপরিহিতা ও শ্মশানচারিণী। এই ছবিতেও তিনি
স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা ও তাঁর নিম্নবস্ত্রে সোনার পাড়; যা বিধবার বেশের
সঙ্গে বেমানান। অষ্টাদশ শতাব্দীর একটি নেপালি পুথিচিত্রে আবার ধূমাবতীর
সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি মূর্তি দেখা যায়। দেবী এখানে সম্পূর্ণ নগ্না,
উন্নতস্তনযুক্তা, মুক্তাহার ও মুকুট পরিহিতা, পদযুগল দুপাশে দিয়ে ময়ূরের
উপর দণ্ডায়মানা, এবং একটি দর্পণে স্বীয় মুখমণ্ডল দর্শনরতা। তাঁর
চতুর্পার্শ্বে অগ্নিবলয়, যা সম্ভবত শ্মশানচিতাগ্নির প্রতীক।
ধূমাবতী সর্বক্ষেত্রেই বিধবা রূপে কল্পিতা হন। তাই তিনিই একমাত্র
মহাবিদ্যা, যাঁর স্বামী নেই। যদিও তিনি শিবেরই স্ত্রী ছিলেন; কিন্তু শিবকে
তিনি ভক্ষণ করে ফেলেন এবং পরে শিব কর্তৃক পরিত্যক্তা হন। এই রূপে তিনি
মহাবিশ্বের পুরুষকে ধ্বংস করে শূন্যের সঙ্গে বিরাজমান হন; কিন্তু তা
সত্ত্বেও তাঁর মহাশক্তি সত্ত্বাটি ক্ষুন্ন হয় না।অনেক গ্রন্থেই ধূমাবতীর
সদাঅতৃপ্ত ক্ষুধা ও তৃষ্ণার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এটি তাঁর
অতৃপ্ত কামনাবাসনার প্রতীক।
দেবীর অশ্ববিহীন রথারূঢ়া বিধবার বেশটি সমাজ ও জীবন থেকে নির্বাসিতা নারীর
প্রতীক। তিনি "সকল দুর্ভাগ্য, অনাকর্ষণীয় ও অমঙ্গলের প্রতীক"।তিনি দরিদ্র,
ভিখারিণী ও কুষ্ঠরোগাক্রান্তা। তিনি বাস করেন "জগতের ক্ষত", মরুভূমি, ভাঙা
বাড়ি, দারিদ্র, ছেঁড়া কাঁথা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কলহ, সন্তানশোক, বন ও
অন্যান্য বর্বর অধ্যুষিত অঞ্চলে।সাধারণত বিধবাদের অমঙ্গলজনক, বিপজ্জনক ও
অশুভক্ষমতার অধিকারিণী বলে সন্দেহ করা হয়। তাই দিব্যবিধবা ধূমাবতীকেও সকলে
ভয় করেন। ধূমাবতীকে কুটিল বৃদ্ধা বা ডাইনি বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি চতুর
ও কলহপ্রিয়া। এটি জীবনের ভয়ংকর দুঃখগুলির প্রতীক।
ব্যতিক্রমী চিত্রকলায় ধূমাবতী যৌবনবতী ও সালংকারা, তিনি যৌনেচ্ছা
উদ্দীপনকারিণী, আকর্ষণীয়া অথচ অমঙ্গলময়ী বিধবা। তাঁর সহস্রনাম স্তোত্রে
বলা হয়েছে যে, তিনি আনন্দপ্রদায়িনী, সর্বসুন্দরী ও মাল্য, অলংকার ও
বস্ত্রভূষিতা। এই স্তোত্র অনুযায়ী, তিনি যৌনতার দেবী; রতি তাঁর রূপভেদ।
উল্লেখ্য, রতি শব্দের আক্ষরিক অর্থ "যৌনসংগম" এবং এটি হিন্দু প্রেমের
দেবীরও নাম। তিনি যৌনসংগম উপভোগ করেন; যেখানে যৌনক্রিয়া চলে, সেখানে
উপস্থিত থাকেন এবং স্বয়ং যৌনাচারে অংশ নেন। তিনি মদ্যপান করতে ভালবাসেন
এবং উন্মত্তা অবস্থায় থাকেন। এই কারণে মদ্যপেরা তাঁর পূজা করে। পঞ্চমকার
সহযোগে তন্ত্রসাধনার সঙ্গেও তিনি সম্পৃক্তা থাকেন।
ধূমাবতী নারীর সমাজবিরোধী ও অমঙ্গলময় সত্ত্বার প্রতীক। তিনি লক্ষ্মীর
বিপরীত শক্তি।অলক্ষ্মীর মতো ধূমাবতীও বর্ষাকালের চার মাসে (চতুর্মাস্য)
পূজিতা হন। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় অশুভ জলশক্তি সূর্যালোককে আচ্ছন্ন
করে রাখে এবং এই সময় বিষ্ণু নিদ্রা যান। এই সময় অন্ধকার রাজত্ব করে এবং
আত্মা তাঁর নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য হারায়। এই সময়টিকে অশুভ মনে করা হয় এবং
বিবাহাদি কোনো শুভ কাজ এই সময় হয় না।
দেবীর মূর্তিকল্পে মৃত্যুর বাহক কাকের উপস্থিতি এবং বিভিন্ন গ্রন্থাবলিতে
উল্লিখিত তাঁর কাকের ন্যায় বৈশিষ্ট্যগুলি মৃত্যু ও অমঙ্গলের সঙ্গে তাঁর
সম্পর্কের প্রতীক। তাঁর মূর্তিকল্পে মৃত্যুর আর একটি প্রতীক হল
শ্মশানক্ষেত্র ও চিতাগ্নির উপস্থিতি। সহস্রনাম স্তোত্র অনুযায়ী, ধূমাবতী
শ্মশানবাসিনী, শবারূঢ়া, ভষ্মমণ্ডিতা ও শ্মশানচারীদের আশীর্বাদকারিণী।
প্রপঞ্চসারাসার সমগ্র অনুযায়ী তিনি মৃতদেহের শরীর থেকে বস্ত্র সংগ্রহ করে
তা পরিধান করেন।ধূমাবতী তমোগুণের প্রতীক, যা অজ্ঞতা ও অন্ধকারের সঙ্গে
যুক্ত। তিনি মাংস ও মদ্য পছন্দ করেন, তামসিক প্রকৃতির।
নাম ও রূপের বাইরে, মানবীয় বর্গবিভাজনের বাইরে, একাকী ও অদ্বিতীয়া,
প্রলয়রূপিণী তিনি (ধূমাবতী) সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রকাশ করেন, যা আকারবিহীন,
শুভাশুভ, শুদ্ধাশুদ্ধ ও মঙ্গল-অমঙ্গল-বিভেদরহিত।
- David Kinsley.
কথিত আছে, ধূমাবতী মহাপ্রলয়ের সময় উপস্থিত হন। প্রলয়কালে উত্থিত
প্রকাণ্ড কৃষ্ণ মেঘ তাঁর স্বরূপ। এই কারণে সহস্রনাম স্তোত্রে তাঁকে
"প্রলয়রূপিণী", "প্রলয়মত্তা", "প্রলয়কারণস্বরূপিণী" ও "প্রলয়চারিণী"
বলা হয়। অন্যমতে, তিনি মহাকালরূপী শিবের বিলোপের পরেও বিদ্যমান থাকেন। তাই
তিনি "কালশক্তিস্বরূপিণী" এবং কালের বৃত্তের বাইরে অবস্থানকারিণী। ধূমাবতী
মহাপ্রলয় বা শেষ প্রলয়ের এবং বিশ্ববিনাশের পর উত্থিত ধোঁয়ার প্রতীক।
"ধূমাবতী" নামটির অর্থ "ধূম্রময়ী"।কথিত আছে, পোড়ালে ধোঁয়া হয় না, এমন
কিছু উৎসর্গ না করলে তিনি খুশি হন না। তিনি ধূপ ও চিতার ধোঁয়া পছন্দ করেন,
যা ধ্বংসের প্রতীক। তিনি ধোঁয়ার আকারে বিহার করেন এবং যেখানে খুশি সেখানে
যান।
ধূমাবতী সাধারণত অমঙ্গলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলেও সহস্রনাম স্তোত্রে তাঁর
কয়েকটি সদগুণেরও উল্লেখ রয়েছে। তিনি বরদাত্রী ও কোমলহৃদয়া। তাঁর
স্তোত্রে বলা হয়েছে, তিনি নারীগণের মধ্যে বাস করেন এবং তাঁদের দ্বারা
পূজিতা হন। এই স্তোত্রে তাঁকে সন্তানদাত্রীও বলা হয়েছে।
পূর্বপুরুষ বা পিতামহী সত্ত্বায় ধূমাবতী মহাগুরু ও পথনির্দেশকারিণী। তিনি
জীবন ও মৃত্যু-সংক্রান্ত চরম সত্য জ্ঞান প্রদান করেন। যা অবশ্যম্ভাবী তা
আচ্ছাদিত করে তাঁর ধোঁয়া। কিন্তু এর ফলে প্রকাশিত হয় "অজানা ও অরূপের"
গুপ্ত সত্য। ফ্রলে বলেছেন, তাঁর বাইরের দরিদ্রবেশটি একটি
মায়া-আচ্ছাদনমাত্র, যা তাঁর অন্তর্নিহিত সত্য রূপটিকে ঢেকে রাখে। তিনি
প্রতীক সেই "সৌভাগ্যের যা দুর্ভাগ্যে ছদ্মবেশে আমাদের সম্মুখে উপস্থিত
হয়।"ধূমাবতী "যন্ত্রণার শক্তির" মূর্তরূপ। ধূমাবতীর দোষগুলি আসলে ধৈর্য,
সহনশীলতা, ক্ষমাশীলতা ও বৈরাগ্যের মতো গুণগুলির জন্মদাতা। জীবনের দোষগুলি
প্রকাশ না পেলে, সেই দোষের উত্তরণ ঘটে না এবং সত্যও মায়ার ধূম্রাচ্ছাদনের
আড়ালেই থেকে যায়।
ধূমাবতীর বাইরের অমঙ্গলময় সত্ত্বা ও তাঁর ভয়ংকরী মূর্তিটি কামনাবাসনার
নিবৃত্তিকে চরমপ্রাপ্তি মনে করার বিপদটি উদ্ঘাটন করে। কুলো শস্য বাছাইয়ের
কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি বাইরের মায়া থেকে অন্তরের বাস্তবকে বেছে নেওয়ার
প্রতীক। তাঁর কুৎসিত রূপ ভক্তকে এই শিক্ষাই দেয় যে, বাইরের চাকচিক্যময়
রূপের বদলে অন্তর্নিহিত সত্যই মূল বস্তু।
ধূমাবতী সেই আদি অন্ধকার ও অজ্ঞানের মূর্তরূপ, যা থেকে মায়ার সংসারের
সৃষ্টি। তিনি সৃষ্টির পূর্বে ও ধ্বংসের পরে এই অন্ধকার ও অজ্ঞানতার প্রতীক।
এই অজ্ঞানতা, যা সর্বোচ্চ সত্যকে ঢেকে রাখে, তাও প্রয়োজনীয়। কারণ এই
অজ্ঞানতার উপলব্ধি না থাকলে, সত্য জ্ঞান লাভ করা সম্ভবপর নয়। ধূমাবতী
চৈতন্যের প্রাক-সৃষ্টি রূপ যোগনিদ্রা এবং যে আদি নিদ্রা বা মহাশূন্যে সকল
সৃষ্টি মিলিত হয়ে ব্রহ্মে বিলীন হয়, তারও প্রতীক। এই মহাশূন্য শুদ্ধ
চৈতন্য, চিত্তচাঞ্চল্যরোধকারী এবং নৈঃশব্দ।এমনকি ধূমাবতীর রোগসৃষ্টিকারী
সত্ত্বাটিরও একটি ভাল দিক রয়েছে। রোগের মাধ্যমে তিনি দুষ্টকে শাস্তি দেন
এবং জগৎ সংসারের স্থিতি বজায় রাখেন।ধূমাবতী হৃদপিণ্ড বা শরীরের মধ্যভাগের
সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
কোনো কোনো মতে, ধূমাবতী কালীর বৃদ্ধা রূপ। এই রূপ কালীর কালোত্তীর্ণা
সত্ত্বা ও অরূপ জীবনীশক্তির প্রতীক। অন্য এক মতে, ধূমাবতী হলেন শ্মশানকালীর
অন্য রূপ। কালীকুল ঐতিহ্যে ধূমাবতী মহাশক্তির এক ভয়ংকরী রূপ হিসেবে
কল্পিত হন।ধূমাবতীর নাম স্তোত্রে তাঁকে পার্বতী ও সতীর অংশ বলা হয়েছে এবং
তাঁকে দানবদলনী রূপে বন্দনা করা হয়েছে।
ধূমাবতীকে অমঙ্গলের দেবী মনে করে সাধারণ ক্ষেত্রে এড়িয়ে চলা হলেও, তাঁকে
কোমলহৃদয়া এবং ভক্তের মনোবাঞ্ছাপূর্ণকারী বরদাত্রী রূপে বর্ণনাও করা হয়ে
থাকে। অনেক স্থানেই ধূমাবতীকে সিদ্ধি বা অলৌকিক ক্ষমতার প্রদানকারিণী, বিপদ
থেকে উদ্ধারকারিণী, সকল কামনা পূর্ণকারিণী এবং মোক্ষদাত্রীরূপে বর্ণনা করা
হয়েছে।ধূমাবতী যে সকল অমঙ্গলজনক বিষয়গুলির দেবী, সেগুলি ঠেকাতে এবং
সত্যের ধূম্রাচ্ছাদন উন্মোচন করতে তাঁর পূজা করা হয়।তিনি অপবিত্রতা,
অমঙ্গলের প্রতীক ও সমাজবহির্ভূত বলে তাঁর পূজা করলে পূজক সমাজের
নিত্যনৈমিত্তিক দ্বন্দ্বের বাইরে দৃষ্টিপাত করার শক্তি অর্জন করেন এবং সত্য
জ্ঞান লাভ করতে সমর্থ হন।
যদিও বিবাহিত ব্যক্তিদের ধূমাবতীর পূজা করতে বারণ করা হয়। কথিত আছে,
ধূমাবতীর পূজা করলে হৃদয়ে নির্জনতার পিপাসা বৃদ্ধি পায় এবং জাগতিক বিষয়ে
বিতৃষ্ণা জাগে, যা আধ্যাত্মিক সাধনার সর্বোচ্চ বৈশিষ্ট্য। এই কারণে
ধূমাবতীর পূজা সর্বত্যাগী ও পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা
উপযুক্ত। ধূমাবতীকে একাকী ব্যক্তিদের, বিশেষত বিধবাদের প্রতি পক্ষপাতী বলে
বর্ণনা করা হয়। বিধবারাই একমাত্র তাঁর শক্তি সহ্য করতে পারেন বলে মনে করা
হয়।
ধূমাবতীর মন্ত্রটি হল "ধূঁ ধূঁ ধূমাবতী স্বাহা"। এই মন্ত্রে তাঁর "ধূঁ"
বীজমন্ত্রটিও অন্তর্ভুক্ত। এই মন্ত্রেই তাঁর পূজা হয়। কখনও কখনও যন্ত্রেও
তাঁর পূজা করা হয়। ভক্তেরা অমঙ্গল ও মৃত্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে
ধূমাবতীর পূজা করেন। ধূমাবতীর পূজায় পূজককে মন থেকে সকল চিন্তা মুছে ফেলে
অচিন্ত্য অরূপের ধ্যান করতে হয়, এই মহাশূন্যরূপী অরূপেরই প্রতীক হলেন
ধূমাবতী।
শক্তিসংগম তন্ত্র মতে, কোনো ব্যক্তিকে "উচাটন" বা নির্মূল করতে ধূমাবতীর
পূজা করা যায়। পূজককে সেক্ষেত্রে জগত ও দেবীর মন্ত্রটিকে ধূসর রূপে কল্পনা
করতে হবে। তাঁকে দাঁতে কালো রং করতে হবে, কালো পোষাক পরতে হবে, এবং
অল্পাহার, ভূমিশয্যা ও ইন্দ্রিয়দমনের মতো কয়েকটি নিয়ম পালন করতে হবে। এই
পদ্ধতিটির "কাককর্ম"; অর্থাৎ, অপরের ক্ষতি করতে হলে তাঁকে "তাঁর মনকে
কাকের ন্যায় করে তুলতে হবে"। অন্য একটি তন্ত্রগ্রন্থের মতে, পূজককে
ধূমাবতীয় মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে শ্মশানক্ষেত্রে একটি কাক দগ্ধ করে
শত্রুর ঘরে ছড়িয়ে দিতে হবে, তবেই সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে।এই গ্রন্থে আরও বলা
হয়েছে যে, ধূমাবতীকে কেবলমাত্র দক্ষিণমার্গেই পূজা করতে হবে।কালরুদ্র
তন্ত্র গ্রন্থে, ধূমাবতীকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে পূজা করার কথা বলে হলেও
শাক্তপ্রমোদ গ্রন্থে সিদ্ধি অর্জন ও শত্রু বিনাশের জন্য তাঁর পূজার উল্লেখ
রয়েছে।
রাত্রিকালে শ্মশানক্ষেত্রে ধূমাবতীর পূজা করা হয়। পূজককে নগ্নগাত্রে
কেবলমাত্র কৌপিন পরিধান করে তাঁর পূজা করতে হয়। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথি
ধূমাবতীর পূজার পক্ষে প্রশস্ত। পূজককে পূজার দিন সারাদিন-সারারাত উপবাস করে
মৌনী থাকতে হয়। এছাড়া তাঁদের শ্মশান, বন বা কোনো নির্জন স্থানে ভিজে
কাপড়ে পাগড়ি মাথায় দিয়ে ধূমাবতীর মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে হোম করতে
হয়।
ধূমাবতীর মন্দিরের সংখ্যা অত্যন্ত অল্প। বারাণসীর একটি মন্দিরে ধূমাবতী
হলেন প্রধান দেবতা। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি ও গুয়াহাটির নিকটবর্তী কামাখ্যা
মন্দিরের কাছে ধূমাবতীর ছোটো মন্দির রয়েছে। বারাণসীর মন্দিরটিকে শক্তিপীঠ
বলে দাবি করা হয়। এই মন্দিরে দেবী রথারূঢ়া ও চতুর্ভূজা, তাঁর চার হাতে
কুলো, ঝাঁটা, পাত্র ও অভয়মুদ্রা।এখানে ফল ও ফুল দিয়ে দেবীর পূজা করা হলেও
মদ, ভাঙ, সিগারেট, মাংস, এমনকি রক্ত দিয়েও পূজা করা হয়ে থাকে।সন্ন্যাসী ও
তান্ত্রিকরা এই মন্দিরে ধূমাবতীর পূজা করেন।দেবীর অমঙ্গলজনক সত্ত্বাটির
জন্য কেবলমাত্র তান্ত্রিক বীরাচারেই দেবীর পূজা করা হয়।তবে এই মন্দিরে
দেবী গ্রামদেবতা বা স্থানীয়দের রক্ষাকর্ত্রীরূপেও পূজিতা হন। এখানে
বিবাহিত যুগলেও পূজা উৎসর্গ করে থাকেন।
•
বগলামুখী : শত্রুনিষ্ক্রিয়কারিনী দেবী। ঈর্ষা, ঘৃণা ও
নিষ্ঠুরতার মতো মানবচরিত্রের অন্ধকার দিক নিয়ন্ত্রণ করেন।
তাঁকে
সারস-মুণ্ড রূপেও কল্পনা করা হয়।
বগলামুখি হল হিন্দু শাস্ত্র মতে দশমহাবিদ্যার একজন অন্যতম দেবী । তাকে উত্তরভারতে
কোথাও কোথাও পিতাম্বরা মা নামেও ডাকা হয়ে থাকে । বগলামুখি মূলত দুটি শব্দ থেকে
এসেছে এক বগল (যার সংস্ক্বত মূল হবে ভলগা) এবং অন্যটি হল মুখ। এ নামটির অর্থ
দাঁড়ায়, যে মুখের ক্যাপচার বা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে । অনেকে অবশ্য “কপিকল মুখ”
হিসাবেও এই নামটির অর্থ করে থাকেন।
বলগামুখি দেবীর একটি সুন্দর রুপ আছে এবং তিনি হলুদ রঙ এর পোষাক পড়ে
থাকেন । একটি ক্রিসেন্ট চাঁদ থাকে তার
মাথার উপর এবং তিনি একটি সিংহাসনে উপবিষ্ট থাকেন । দেবীর দুই রুপের বিবরণ পাওয়া
যায় । যার একটিতে তিনি দ্বি-ভূজা (দুই হাত বিশিষ্ট) অন্যটিতে তিনি চতুর্ভূজা (চার
হাত বিশিষ্ট)।বলগামুখীকে পিতম্বরা এবং ব্রহ্মাস্ত্ররুপী ও বলা হয় ।
প্বথীবীতে একবার এক বিশাল ঝড় হয়েছিল। সাওরাস্থা অঞ্চলের সে ঝড়ে
সবকিছু ধ্বংস হতে চলেছিল। তখন সবাই দেবী পিতাম্বরা বা বগলামূখীকে স্মরন করেছিলেন ।
দেবী সেই সময়ে “হরিদ্রা সরোবর” থেকে উঠে ছিলেন এবং মহাপ্রলয় হতে রক্ষা করেছিলেন
যার স্ম্বতিচিহ্ন বহন করছে ভারতের মধ্য প্রদেশের ডাটিয়ার পিতাম্বরা পিতমের “হরিদ্রা
সরোবর”।
দেবী বগলামুখীর প্রধান মন্দির বানখান্দি, হিমাচল প্রদেশ, ভারতে হলেও
দেবীর আরো কিছু মন্দির দেখতে পাওয়া যায় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বাংলাদেশ ও
নেপালে । চেন্নাইয়ের মন্দির টির ওয়েব সাইট ঠিকানা হল http://sreebagalamukhidevitemple.com/ । যেকেউ ইচ্ছা
করলে দেখে নিতে পারেন ।
শ্রী যোজ্ঞেশ্বর এর "Baglamukhi
Sadhana Aur Siddhi" বইতে বলগামূখী দেবী সম্পর্কে আরো বিস্তারিত পাওয়া যাবে ।
•
মাতঙ্গী : কর্তৃত্ব শক্তির দেবী। জাতিহীন দেবী (কালীকুল সম্প্রদায়ে), ললিতার প্রধানমন্ত্রী (শ্রীকুল সম্প্রদায়ে); তান্ত্রিক সরস্বতী।

দেবী
মাতঙ্গী হল দশমহাবিদ্যার অন্যতম কারো মতে নবম মহাবিদ্যা। দেবী মূলতঃ
স্বরস্বতী দেবীর তাত্রিক রুপ হিসাবেই চিহ্নিত হন । মাতঙ্গী দেবী সংগীত, কলা
বিশেষত আর্টসের উপর আধিপত্য বিস্তার কারী । তাকে একজন চন্ডালিনী হিসাবে
বর্ণনা করা হয়ে থাকে ।
ভারত তন্ত্রসার ধ্যান মন্তে দেবীকে উচিষ্ঠা মাতঙ্গী হিসাবে দেখানো হয়েছে।
এখানে মাতঙ্গী দেবীকে একটি মৃতদেহ উপর উপবিষ্ট এবং লাল জামা, লাল জহরত পরেন
। দেবীর সম্পূর্ণরূপে বিকশিত স্তন সঙ্গে একটি অল্প বয়স্ক,( ষোল বছর
বয়সী) কুমারী হিসাবে অভিহিত করা হয়। তিনি একহাতে একটি মস্তক এবং দুই হাতে
একটি তরবারি বহন করেন। তার গায়ের রং নীল হিসাবে বর্ণনা করা হয় । তার কোমর
পাতলা। তার কপাল ক্রিসেন্ট চাঁদ । তার তিনটি চোখ এবং হাস্যমুখে থাকেন ।
তিনি মণিরত্ন পরিধান করেন এবং একটি অলংকার সজ্জিত সিংহাসনে বসেন।
Shyamaladandakam মতে, মাতঙ্গী একটি রুবি-খচিত বীনা
বাজান এবং মিতভাষী । ধ্যান মন্ত্রতে চার হাত বিশিষ্ট কালো পান্না গাত্রবর্ণ
, পুরো স্তন লাল কুমকুম পাউডারএ উদ্বর্তিত, এবং তার কপাল উপর একটি
ক্রিসেন্ট চাঁদ সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে। তাকে দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর মত
প্রায়ই বর্ণনা করা হয় ।তার সবুজ গাত্রবর্ণ গভীর জ্ঞান সঙ্গে যুক্ত তাই
প্রায়ই বক্তৃতায় প্রতিনিধিত্বমূলক, তার হাতে একটি তোতাপাখি দেখানো হয়।
মুন্ডমালা নামের একটি গ্রন্থের দশমহাবিদ্যার অস্তিত্ব পাওয়া যায় মনে করা হয়
যে বিষনুর দশ অবতারের প্রাথমিক রুপ। মাতঙ্গীকে শেষ অবতার কল্কির রুপক
হিসাবেই মনে করা হয় ।
শক্তি ভাগবত পুরান অনুযায়ী দশমহাবিদ্যার যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে দেবী
মাতঙ্গীকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শিবকে আক্রমণ করতে দেখান হয়েছে।(গল্পটি
অন্য মহাবিদ্যার আলোচনাতেও আছে দেখে নিতে অনুরোধ করছি)
শক্তিসঙ্গমা তন্ত্রে উচ্ছিষ্টা মাতঙ্গীনীর উতপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
একবার দেবতা বিষ্ণু ও তার স্ত্রী লক্ষ্মী শিব এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী
পার্বতীকে (সতীর পুনরায় দেহধারণ) পরিদর্শন করেন। তাদের খাবার খাওয়ার সময়
তাদের খাদ্য অবশিষ্ট থাকে এবং সেখানে একটি সুন্দর কুমারীকে পড়ে থাকতে
দেখেন । কিছু খাবার দেবতারা মাটিতেও ফেলেছিল । ঐ কুমারি অবশিষ্ট খাদ্য
গ্রহন করেন বলে সেদিন থেকেই কুমারী উচ্ছিষ্টা মাতঙ্গীনী নামে পরিচিত হন।
এই মাতঙ্গীনীকে দূষিত রাস্ট্রের সাথেও তুলনা করা হয়ে থাকে।মাতঙ্গী হচ্ছে
সেই স্তবক যারা খাদ্য গ্রহন করে হাত-মুখ ধৌত করেনা পুনরায় খাদ্য গ্রহন করে
মূলধারার হিন্দুধর্মে এ ধরনের অভ্যাসকে নিষিদ্ধ করা হয়।সে কারনেই ঋতুবতী
কন্যাদেরকে মুল পূজার থেকে দূরে রাখা হয় তাছাড়াও মাসিকের দাগ লাগা কোন
কাপড়কেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেপালে মাতঙ্গী সম্প্রদায় রয়েছে যারা ময়লা
জামা-কাপড়ই শুধু নয় তারা বলির পশুর থেকেও কাপড় সংগ্রহ করে থাকে।যা মূলধারার
হিন্দুধর্মে কোনমতেই গ্রহনযোগ্য না। নেপালে এদেরকে ট্যাবু হিসাবে চিহ্নিত
করা হয় ।
তবে কোথাও কোথাও রাজ-মাতঙ্গী পূজা উদযাপিত হতে পারে । উচ্ছিস্ট মাতঙ্গী
পূজা ও হয়ে থাকে । বাংলাদেশেও মাতঙ্গী পূজা হতে পারে এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ
নিশ্চিত নই।
দেবী মাতঙ্গী হল দশমহাবিদ্যার অন্যতম কারো মতে নবম মহাবিদ্যা। দেবী মূলতঃ
স্বরস্বতী দেবীর তাত্রিক রুপ হিসাবেই চিহ্নিত হন । মাতঙ্গী দেবী সংগীত, কলা
বিশেষত আর্টসের উপর আধিপত্য বিস্তার কারী । তাকে একজন চন্ডালিনী হিসাবে
বর্ণনা করা হয়ে থাকে ।
ভারত তন্ত্রসার ধ্যান মন্তে দেবীকে উচিষ্ঠা মাতঙ্গী হিসাবে দেখানো হয়েছে।
এখানে মাতঙ্গী দেবীকে একটি মৃতদেহ উপর উপবিষ্ট এবং লাল জামা, লাল জহরত পরেন
। দেবীর সম্পূর্ণরূপে বিকশিত স্তন সঙ্গে একটি অল্প বয়স্ক,( ষোল বছর
বয়সী) কুমারী হিসাবে অভিহিত করা হয়। তিনি একহাতে একটি মস্তক এবং দুই হাতে
একটি তরবারি বহন করেন। তার গায়ের রং নীল হিসাবে বর্ণনা করা হয় । তার কোমর
পাতলা। তার কপাল ক্রিসেন্ট চাঁদ । তার তিনটি চোখ এবং হাস্যমুখে থাকেন ।
তিনি মণিরত্ন পরিধান করেন এবং একটি অলংকার সজ্জিত সিংহাসনে বসেন।
Shyamaladandakam মতে, মাতঙ্গী একটি রুবি-খচিত বীনা বাজান এবং মিতভাষী ।
ধ্যান মন্ত্রতে চার হাত বিশিষ্ট কালো পান্না গাত্রবর্ণ , পুরো স্তন লাল
কুমকুম পাউডারএ উদ্বর্তিত, এবং তার কপাল উপর একটি ক্রিসেন্ট চাঁদ সঙ্গে
বর্ণনা করা হয়েছে। তাকে দেবী ত্রিপুরা সুন্দরীর মত প্রায়ই বর্ণনা করা হয়
।তার সবুজ গাত্রবর্ণ গভীর জ্ঞান সঙ্গে যুক্ত তাই প্রায়ই বক্তৃতায়
প্রতিনিধিত্বমূলক, তার হাতে একটি তোতাপাখি দেখানো হয়।
মুন্ডমালা নামের একটি গ্রন্থের দশমহাবিদ্যার অস্তিত্ব পাওয়া যায় মনে করা হয়
যে বিষনুর দশ অবতারের প্রাথমিক রুপ। মাতঙ্গীকে শেষ অবতার কল্কির রুপক
হিসাবেই মনে করা হয় ।
শক্তি ভাগবত পুরান অনুযায়ী দশমহাবিদ্যার যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে দেবী
মাতঙ্গীকে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে শিবকে আক্রমণ করতে দেখান হয়েছে।(গল্পটি
অন্য মহাবিদ্যার আলোচনাতেও আছে দেখে নিতে অনুরোধ করছি)
শক্তিসঙ্গমা তন্ত্রে উচ্ছিষ্টা মাতঙ্গীনীর উতপত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,
একবার দেবতা বিষ্ণু ও তার স্ত্রী লক্ষ্মী শিব এবং তার দ্বিতীয় স্ত্রী
পার্বতীকে (সতীর পুনরায় দেহধারণ) পরিদর্শন করেন। তাদের খাবার খাওয়ার সময়
তাদের খাদ্য অবশিষ্ট থাকে এবং সেখানে একটি সুন্দর কুমারীকে পড়ে থাকতে
দেখেন । কিছু খাবার দেবতারা মাটিতেও ফেলেছিল । ঐ কুমারি অবশিষ্ট খাদ্য
গ্রহন করেন বলে সেদিন থেকেই কুমারী উচ্ছিষ্টা মাতঙ্গীনী নামে পরিচিত হন।
এই মাতঙ্গীনীকে দূষিত রাস্ট্রের সাথেও তুলনা করা হয়ে থাকে।মাতঙ্গী হচ্ছে
সেই স্তবক যারা খাদ্য গ্রহন করে হাত-মুখ ধৌত করেনা পুনরায় খাদ্য গ্রহন করে
মূলধারার হিন্দুধর্মে এ ধরনের অভ্যাসকে নিষিদ্ধ করা হয়।সে কারনেই ঋতুবতী
কন্যাদেরকে মুল পূজার থেকে দূরে রাখা হয় তাছাড়াও মাসিকের দাগ লাগা কোন
কাপড়কেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নেপালে মাতঙ্গী সম্প্রদায় রয়েছে যারা ময়লা
জামা-কাপড়ই শুধু নয় তারা বলির পশুর থেকেও কাপড় সংগ্রহ করে থাকে।যা মূলধারার
হিন্দুধর্মে কোনমতেই গ্রহনযোগ্য না। নেপালে এদেরকে ট্যাবু হিসাবে চিহ্নিত
করা হয় ।
তবে কোথাও কোথাও রাজ-মাতঙ্গী পূজা উদযাপিত হতে পারে । উচ্ছিস্ট মাতঙ্গী
পূজা ও হয়ে থাকে ।
•
কমলাকামিনী : বরাভয় প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্যরূপ। তান্ত্রিক লক্ষ্মী নামেও অভিহিতা।
হিন্দু পুরানের দশমহাবিদ্যার অন্যতম দেবী কমলা কামিনী । কমলাকামিনী বরাভয়
প্রদায়িনী শুদ্ধ চৈতন্যের দেবী। ভাগ্যদেবী লক্ষ্মীর অন্যরূপ। তান্ত্রিক
লক্ষ্মী নামেও তিনি পরিচিত। কমলা মানে হচ্ছে পদ্ম । কমলাকামিনী দেবীর যে
রুপ কল্পনা করা হয় তাতে দেখা যায় যে, দেবীকে চারটি বড় হাতি স্নান করাচ্ছেন
এবং দেবী পন্মের উপর বসে আছেন । তারচারটি হাত আছে দুই হাতে কামিনী আর অন্য
দুই হাত রয়েছে আশির্বাদ দেবার ভংগিতে । দেবীকে মূলত বিশুদ্ধতার প্রতিক
হিসাবে দেখানো হয়েছে। কমলার সঙ্গে সমৃদ্ধি ও সম্পদ, উর্বরতা ও ফসল, এবং
সৌভাগ্য এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত উপাদান রয়েছে।
কমলা হল প্রথম এবং প্রধান স্ত্রী শক্তি । অনেকে কমলা কে স্ত্রীযোনীর সংগে
তুলনা করে থাকেন । সুন্দরের প্রতীক হিসাবে আমরা যে সকল দেবীকে পাই তাদের
মধ্যে অন্যতম হল এই কমলা কামিনী দেবী। কোথাও কোথাও তাকে কমলা সুন্দরী ও বলা
হয়েছে । বাচ্চাদের কাছে একটি গল্পের মাধ্যমে প্রথম প্রথম যৌনতা সম্পর্কে
জানানো হয়ে থাকে আর তা হল ফুলের উপর মৌমাছির পরাগায়ন । এখানে ফুলকে স্ত্রী
অংগ আর মৌমাছিকে পুরূষ হিসাবে দেখানো হয় । সেক্ষেত্রে পদ্ম হল একটি ফুল এবং
যা দেখতে অনেকটা স্ত্রী যৌনাংগের মত বিধায় এই কমলাকামিনীকে দ্বিতীয়
মহামন্ত্র দ্বারা পূজা করা হয়ে থাকে । মনে করা হয় যে শিবের “ওম” এর পরেই
“ইম” মন্ত্রের অবস্থান ।
গুহ্যাতিগুহ্য তন্ত্রে বলা হয়েছে
মহাবিদ্যাগণই হলেন বিষ্ণু দশ অবতারের উৎস। দেবীর এই দশ রূপ, তা ভয়ংকরই হোক
বা কোমল, বিশ্বজননী রূপে পূজিত হয়।